বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ এবং সৌরবিদ্যুৎ অবহেলিত কেন?
বাংলাদেশে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোর বর্জ্য অপসারণ, বর্জ্য রিসাইক্লিং ও কম-দূষণের মাধ্যমে বর্জ্য পোড়ানো কিংবা ব্যবস্থাপনা একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বর্জ্য সংগ্রহ করে জনবসতি থেকে দূরবর্তী কোন স্থানে তা জমা করে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পুঁতে ফেলা, পুড়ে ফেলা বা রূপান্তরিত করা এখনো এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয়বহুল, জটিল এবং ব্যর্থতাপূর্ণ কার্যক্রম হিসেবে বহাল রয়ে গেছে। দুঃখজনকভাবে এই একটি ব্যাপারে আমরা এখনো মধ্যযুগের গোমরাহি থেকে মুক্তির পথে তেমন অগ্রগতি অর্জন করতে পারলাম না!
এই দায়িত্বটিকেই দেশের এসব প্রতিষ্ঠানের অন্যতম অগ্রাধিকার-প্রাপ্ত কর্তব্য হিসেবে আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। অথচ, বর্তমান উন্নত বিশ্বে এই দায়িত্বটি অত্যন্ত পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে সম্পন্ন করার প্রযুক্তি প্রয়োগের নজির যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও আমরা স্বাধীনতার ৫১ বছর পার করে এসে শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এক্ষেত্রে কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার নানা ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি এখন সুলভে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা যায়। বর্জ্য-রিসাইক্লিং এখন অনেক দেশে পরিবেশ-সুরক্ষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ডাইমেনশান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে, যার অন্যতম প্রক্রিয়া হলো বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন। খোলা আবর্জনার ভাগাড়ে বর্জ্য পোড়ানো অত্যন্ত পরিবেশ-দূষণকারী প্রক্রিয়া।
এই আগুন এবং ধোঁয়া আশেপাশের এলাকাগুলোর জনজীবনে বড় ধরনের যন্ত্রণাদায়ক অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, জনস্বাস্থ্যের জন্যেও বড়সড় বিপদ ডেকে আনে। আধুনিক চুল্লীর মাধ্যমে বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে পরিবেশ-বিপর্যয় অনেকখানি কমিয়ে ফেলা যায়। অতএব, এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিট-প্রতি খরচ বেশি পড়লেও যেহেতু এক্ষেত্রে খানিকটা পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে বর্জ্য-ব্যবস্থাপনাই প্রধান উদ্দেশ্য থাকে তাই উন্নত দেশগুলোতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়। ‘বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ’ এদেশে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রায়শ উচ্চারিত হলেও স্বাধীনতার ৫১ বছর এবং ১৯৯১ সালে ভোটের রাজনীতি চালু হওয়ার ৩১ বছর পার হওয়ার পরও দেশে আজো একটি ‘বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ’ প্রকল্প চালু হলো না, এই দুঃখ কোথায় রাখি?
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এ-ব্যাপারে ১৯৯৪ সাল থেকে কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও ফলাফল শূন্য। আমার জানামতে চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র জনাব মহিউদ্দিন চৌধুরী এ-ব্যাপারে অনেকদূর এগিয়েছিলেন, কিন্তু নব্বইয়ের দশকে এ-সম্পর্কিত তাঁর প্রকল্প-প্রস্তাবটি তদানীন্তন বিএনপি সরকার বাতিল করে দিয়েছিল। তখনকার সরকারী দলের প্রভাবশালী নেতা মীর নাসিরউদ্দিন ক্ষমতা ফলিয়ে ঘোষণা করেছিলেন যদ্দিন মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকবেন তদ্দিন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন-প্রেরিত কোন প্রকল্প স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় পাশ করবে না। তাঁর উষ্মার কারণ, তিনি এর কিছুদিন আগেই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থী হয়েও মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন।
ঐ পরাজয়ের জ্বালা ভুলে যাওয়া কঠিন, কিন্তু তাঁর এহেন জনবিদ্বেষী ও সংকীর্ণ মনোভাব খুবই দুঃখজনক। আরো দুঃখজনক হলো, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সংসদীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকারে আসীন হলেও চট্টগ্রাম বন্দরে মার্কিন কোম্পানি স্টিভেডরিং সার্ভিসেস অব এমেরিকা (এসএসএ) কে ঠিকাদারি প্রদানের ইস্যু নিয়ে মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রবল বিরোধপূর্ণ-সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অন্য অনেক প্রকল্পের মত এর শিকার হয় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প-প্রস্তাবটিও। অতএব, ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগের ক্ষমতার মেয়াদে আর কোন অগ্রগতি হয়নি এই প্রকল্প-প্রস্তাবের। আবার ২০০১ সালে সরকারে ক্ষমতাসীন হয় বিএনপি-জামায়াত জোট, অতএব তাদের ২০০১-২০০৬ মেয়াদে আবারো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তাদের রোষানলে পতিত হয় মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী তৃতীয় মেয়াদে মেয়র থাকার কারণে।
২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীকে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করে, ঐ সরকারের আমলে তিনি আর মুক্তি পাননি । অতএব, ঐ আমলেও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পটি কোল্ড-স্টোরেজে থেকে যায়। ২০০৯ সালে যখন শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসেন তখনো মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ক্ষমতায় ছিলেন। তখন এই প্রকল্পটি নিয়ে সরকারের কিছুটা নড়াচড়া শুরু হয়েছিল, কিন্তু ২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে যোগ দিয়ে জনাব মঞ্জুর আলম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে মেয়র হয়ে বসেন তখন বোধগম্য কারণেই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আবার মহাজোট সরকারের কোপদৃষ্টিতে পতিত হয়। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের আ জ ম নাসির মেয়র নির্বাচিত হলেও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন তাঁর অগ্রাধিকার পেতে সমর্থ হয়নি। (হয়তো জনাব মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রিয় প্রকল্প ছিল বলে জনাব নাসির ঐ প্রকল্পটিকে এগিয়ে নেননি! বর্তমান মেয়র জনাব রেজাউল করিম চৌধুরীর মেয়াদেও এ-ব্যাপারে কোন অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি)।
দেশের অন্য কোথাও বর্তমান সরকারের আমলে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন যথাযোগ্য মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। হয়তো বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ এবং কয়লা ও গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মেগা-প্রজেক্টগুলো অনেক কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে ভেবে সরকার-প্রধানের নজর ‘বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ’–এই ছোট ইস্যুটিতে ফিরে আসেনি! কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দেশের ১০টি সিটি কর্পোরেশনের প্রত্যেকটিতে একটি করে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠা পরিবেশ-বান্ধব পদ্ধতিতে বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার দিক্ থেকে অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে।
দেশের আরেকটি দুঃখজনক অবহেলার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সৌরবিদ্যুতের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। গত ২০২০ সালের মধ্যেই ভিয়েতনাম বাড়ীর ছাদের সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৯০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছে। অথচ, বাংলাদেশের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন এখনো এক হাজার মেগাওয়াটের নিচে রয়ে গেছে। এই অবাক-করা তথ্যদুটিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের এনার্জী-সম্পর্কিত সঠিক পথ নির্ধারণের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ববহ বিবেচনা করতে হবে।। কারণ, ২০২০ সাল থেকে এলএনজি’র অভূতপূর্ব আন্তর্জাতিক দামবৃদ্ধি বাংলাদেশের প্রধানত ফসিল-ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানী-নির্ভর বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচকে ইতোমধ্যেই প্রচন্ডভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে, আর ভিয়েতনামের সোলার-এনার্জী উৎপাদনে এই অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জনের খবরটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে বাংলাদেশকে দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে সোলার এনার্জীকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিলে বাংলাদেশও অদূর ভবিষ্যতে এলএনজি-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে সুলভে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো প্রধানত প্রাকৃতিক গ্যাস-নির্ভর। দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের রিজার্ভ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
এলএনজি’র আন্তর্জাতিক দামবৃদ্ধির ফলে দেশের আমদানি খরচ প্রচন্ডভাবে বেড়ে গেছে, যা বিদ্যুৎ খাতকে ইতোমধ্যেই বড়সড় সংকটে ফেলেছে। আরো গুরুতর হলো, ভবিষ্যতের প্রায় ১৫,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানী হিসেবে বাংলাদেশ এলএনজি অথবা কয়লা আমদানির উপর নির্ভর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। যদিও সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট-নির্মাণ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু কয়লা বাদ দিয়ে এলএনজি আমদানিকে যেহেতু অদূর ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান-বিকল্প কৌশল হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল তাই এই কৌশল-পরিবর্তন এখন এলএনজি’র এহেন দাম-উল্লম্ফনের কারণে প্রচন্ড ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। ২০২২ সালের জুলাই মাস থেকে দেশে প্রতিদিন দু’হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লোডশেডিং করা হচ্ছে, ডিসেম্বরের শীতকালেও লোডশেডিং থেকে দেশবাসী নিষ্কৃতি পাচ্ছে না।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের এই জীবাশ্ম জ্বালানী-নির্ভরতা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে ভিয়েতনামের ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ারের সাফল্য কীভাবে অর্জিত হয়েছে তা সরেজমিনে দেখে এসে এদেশের সোলার-পাওয়ার নীতিকে অবিলম্বে ঢেলে সাজাতে হবে। ভিয়েতনাম যেখানে ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার উৎপাদনকে ২০০০ সালেই ৯,০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছে সেখানে এদেশের ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার উৎপাদন এখনো এক হাজার মেগাওয়াটেও পৌঁছাতে পারল না কেন? বাংলাদেশের ‘সাসটেইনেবল এন্ড রিনিউয়েবল এনার্জী ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ স্রেডা (SREDA) তাদের ঘোষিত ন্যাশনাল সোলার এনার্জী রোডম্যাপে ৩০,০০০ মেগাওয়াটের সোলার এনার্জীর টার্গেট অর্জনের সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে ১২,০০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ ছাদভিত্তিক সোলার প্যানেল থেকে আহরণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু, এই রোডম্যাপ ঘোষণার পর অনেকদিন অতিবাহিত হলেও বাস্তবে এই টার্গেট পূরণের কোন কর্মসূচি আজো গৃহীত হলো না!
বিশ্বখ্যাত এনার্জী এক্সপার্ট সাইমন নিকোলাস বলছেন, ১২,০০০ মেগাওয়াটের মধ্যে ৫,০০০ মেগাওয়াট শুধু পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলোর ছাদ ব্যবহার থেকে পাওয়া যেতে পারে, আর সরকারী বিভিন্ন ভবনের ছাদ ব্যবহারের মাধ্যমে আরো ২,০০০ মেগাওয়াট পাওয়া যাবে। দেশের বড় বড় নগর ও মফস্বল শহরগুলোর প্রাইভেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ীগুলোর ছাদ ব্যবহারের মাধ্যমে বাকি ৫,০০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন মোটেও অসম্ভব মনে হচ্ছে না, প্রয়োজন হবে সোলার প্যানেল ও ব্যাটারির ভর্তুকি-দাম কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং যুগোপযোগী ‘নেট মিটারিং’ পদ্ধতি চালু করা। ‘নেট মিটারিং’ থেকে যেহেতু জনগণ সরাসরি ব্যয়সাশ্রয়ের মাধ্যমে উপকৃত হয় তাই ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন জনপ্রিয় হতে মোটেও বিলম্ব হবে না। সম্প্রতি নেট মিটারিং সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর এনার্জী উপদেষ্টা ডঃ তওফিক-ই-ইলাহির একটি টিভি বিজ্ঞাপন দেখে স্রেডার ওয়েব সাইটে খোঁজ নিয়ে নিজের বসতবাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপনের উদ্দেশ্যে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ওখানে কোন নির্দেশনাই পাওয়া যায়নি।
ভিয়েতনাম ছাড়াও গণচীন, থাইল্যান্ড, ভারত এবং জার্মানী ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার উৎপাদনে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করেছে। সোলার প্যানেল ও ‘ব্যাটারি’ স্থাপনে সুনির্দিষ্ট ভর্তুকি প্রদান এবং ভর্তুকি-দামে ‘নেট মিটারিং’ স্থাপনে প্রণোদনা প্রদান এসব দেশের সাফল্য অর্জনের প্রধান উপাদান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ‘নেট মিটারিং’ ব্যবস্থায় যেহেতু জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের মাসিক বিদ্যুৎ বিল প্রায় শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার পাশাপাশি উদ্বৃত্ত সোলার-পাওয়ার সরকারের কাছে বিক্রয় করে আয়বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা যায় সেজন্য এই ছাদভিত্তিক সোলার-এনার্জী উৎপাদনকে এসব দেশে দ্রুত জনপ্রিয় করা সম্ভব হয়েছে। এই ‘নেট-মিটারিং’ প্রযুক্তি গণচীন থেকে এখন সুলভে আমদানি করা যাচ্ছে। অথচ, এক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি একেবারেই নগণ্য রয়ে গেল কেন? রূপপুর পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপন করার জন্য আমরা প্রায় তের বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছি, যেখান থেকে ২০২৪ সাল নাগাদ আমরা নাকি ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাব। কিন্তু, এই মহা-বিপজ্জনক আণবিক প্রযুক্তি বাংলাদেশের মত একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশের সীমানার মাঝখানে স্থাপনের দুর্বুদ্ধি যার মাথা থেকেই আসুক না কেন এটাকে আমি কখনোই সমর্থনযোগ্য মনে করিনি।
আমার সুনির্দিষ্ট অভিমত, ছাদভিত্তিক সোলার-পাওয়ার প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিলে ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের ভর্তুকি রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের মোট ব্যয়ের অর্ধেকও হবে না। সৌরবিদ্যুৎ সবচেয়ে পরিবেশ-বান্ধব এবং ঝুঁকিমুক্ত। কিন্তু, এই প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিলে কায়েমী স্বার্থের পুঁজি-লুন্ঠন যেহেতু খুব জমজমাট হওয়ার সম্ভাবনা নেই সেজন্যই হয়তো এদেশের ক্ষমতাসীন মহলে এই জনবান্ধব প্রযুক্তিটির উৎসাহী প্রমোটার পাওয়া যাচ্ছে না! ভিয়েতনামের জনসংখ্যা বাংলাদেশের অর্ধেক, কিন্তু সেখানে ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার উৎপাদন ৯,০০০ মেগাওয়াটে পৌঁছাতে পারল ভিয়েতনামের ক্ষমতাসীন সরকার সত্যিকারভাবে জনবান্ধব হওয়ার কারণে। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত, এক ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ইতোমধ্যেই গণচীন, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডে বাংলাদেশী সাত টাকার নিচে নেমে এসেছে। এর মানে, এলএনজি’র সাম্প্রতিক নাটকীয় দামবৃদ্ধির আগেই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের চাইতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়সাশ্রয়ী হয়ে গিয়েছিল। এলএনজি’র দাম-উল্লম্ফনের পর এখন তো সৌরবিদ্যুৎ তুলনামূলকভাবে আরো সস্তা হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকে নির্দ্বিধায় দেশের বিদ্যুৎ খাতে প্রধান অগ্রাধিকার প্রদান করুন। ২০২১ সালে দেশের শতভাগ জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধায় নিয়ে এসে আপনি যে ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছেন সে সাফল্যকে টেকসই করার জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌরবিদ্যুতকে প্রধান উৎসে পরিণত করা সময়ের দাবি।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়











