ড. মঈনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ২৬ মে, ২০২২ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

পরিবারতন্ত্র শ্রীলংকাকে ডুবিয়েছে, সেখান থেকে বাংলাদেশ কি শিক্ষা নেবে?

শ্রীলংকার ‘লংকাকান্ড’ দেশটাকে চরম অরাজকতায় ডোবাতে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ ছিল শ্রীলংকা। প্রায় শতভাগ জনগণ ছিল শিক্ষিত। দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল ভারতের কেরালার পর দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। চাল উৎপাদনে শ্রীলংকা ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। মানুষের মাথাপিছু জিডিপি ছিল প্রায় চার হাজার ডলার। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকা ছিল সবচেয়ে অগ্রগামী। ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর বিশ্বে একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে এক দশকের মধ্যে শ্রীলংকা এশিয়ার দ্বিতীয় সিঙ্গাপুরে পরিণত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু, ঐ গৃহযুদ্ধে সংখালঘু তামিলদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জনের জন্য শ্রীলংকার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে এবং তাঁর ছোটভাই তখনকার প্রতিরক্ষা সচিব গোতাবায়া রাজাপাকসে যে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিলেন তার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারত তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল যে গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে প্রায় চল্লিশ হাজার বেসামরিক তামিলকে শ্রীলংকার সেনাবাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছে, যা যুদ্ধাপরাধের শামিল। জাতিসংঘ এ-ব্যাপারে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানালেও শ্রীলংকা সরকার পুরো বিষয়টি অস্বীকার করে তদন্তকারী দলকে শ্রীলংকায় প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। এর ফলে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কাছে শ্রীলংকা একটি ‘দুবৃত্ত রাষ্ট্রে’ (pariah state) পরিগণিত হয়। গৃহযুদ্ধে জয়লাভের জন্য শ্রীলংকা বহুলাংশে চীনের সমরাস্ত্র সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ভারত যেহেতু গৃহযুদ্ধে তামিলদেরকে সহায়তা করেছিল তাই ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধে বিজয়ের পরও মাহিন্দা রাজাপাকসের সরকার চীনের দিকে আরো ঝুঁকে পড়ে। চীনের ঋণের অর্থে শ্রীলংকা অনেকগুলো স্বল্প-প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করে। এর পাশাপাশি ‘সভরেন বন্ড’ ছেড়ে তারা দেশ-বিদেশের অর্থ-বাজার থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণ সংগ্রহ করে উন্নয়ন কর্মকান্ডকে গতিশীল করার প্রয়াস চালায়। কিন্তু, প্রকল্পগুলো থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে মাহিন্দা এবং রাজাপাকসে পরিবারের অন্য সদস্যরা কোটি কোটি ডলার আত্মসাৎ করার অভিযোগ চরমাকার ধারণ করায় ২০১৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাহিন্দা মৈত্রীপালা সিরিসেনার কাছে পরাজিত হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন।

সিরিসেনার সরকার মাহিন্দার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাহিন্দার ছোটভাই গৃহযুদ্ধের অন্যতম নায়ক গোতাবায়া রাজাপাকসে অনেকগুলো ‘পপুলিস্ট’ অঙ্গীকারের মাধ্যমে শ্রীলংকার ভোটারদের মন জয় করে আবার বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হন। ঐ নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী গোতাবায়া ১৫ শতাংশ জেনারেল সেলস ট্যাক্সকে ৮ শতাংশে নামিয়ে ফেলেন, এবং ২ শতাংশ ন্যাশনাল রিবিল্ডিং ট্যাক্সকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এতে খুশি হয়ে ২০২০ সালের সংসদীয় নির্বাচনে ভোটাররা রাজাপাকসে পরিবারের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলকে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা সহকারে বিজয় এনে দেয়। মাহিন্দা আবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান, তার সাথে মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন বাসিল রাজাপাকসে, চামাল রাজাপাকসে এবং পরবর্তী জেনারেশনের আরো দু’জন রাজাপাকসে। আরো চারজন রাজাপাকসে সরকারের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় এটাকে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অভূতপূর্ব পরিবারতান্ত্রিক একনায়কত্বের অনন্য নজির বলা চলে।
কিন্তু, এক দশকের ‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার’ নীতি ২০২০ সালেই শ্রীলংকার অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে শুরু করে। চীনের অর্থে নির্মিত হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রত্যাশিত চাহিদা সৃষ্টি করতে না পারায় চীনা ঋণ পরিশোধের জন্য ঐ বন্দরটিকে ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে লীজ দিতে বাধ্য হয় শ্রীলংকা। একইসাথে, হাম্বানটোটায় নির্মিত রাজাপাকসে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিও একেবারেই স্বল্প-ব্যবহৃত বিমানবন্দরে পরিণত হয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস মহামারি আঘাত হানার পর শ্রীলংকায় মানুষ বেশি মারা না গেলেও অর্থনীতিতে বেশ কয়েকটি মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। শ্রীলংকার বৈদেশিক আয়ের সবচেয়ে বড় সূত্র পর্যটন খাতের আয় মহামারির ফলে রাতারাতি শূন্যে নেমে আসে। (অবশ্য, এর আগে ইস্টার ডে বোমা হামলায় বেশ কয়েকজন বিদেশী পর্যটক নিহত হওয়ায় পর্যটন ব্যবসা আগেই বিপর্যয়ে পতিত হয়েছিল)। এর সাথে যুক্ত হয় প্রবাসী শ্রীলংকানদের রেমিট্যান্সে মহামারি-সৃষ্ট ধস, যাতে দেশটির রেমিট্যান্স-আয়ও প্রায় আশি শতাংশ সংকুচিত হয়ে যায়।

সবচেয়ে দুঃখজনক হলো রাতারাতি কৃষিখাতে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ চালুর জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। গোতাাবায়া নিজের খামখেয়ালী সিদ্ধান্তে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এর ফলে এক অভূতপূর্ব ফলন-বিপর্যয়ে পতিত হলো শ্রীলংকার কৃষিখাত। ‘অর্গানিক ফার্মিং’ নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে শ্রীলংকার কৃষিজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এক বছরে বিপর্যয়করভাবে এক-তৃতীয়াংশ কমে গেলো, যার ফলে খাদ্যশস্য আমদানির জন্য ২০২১ সালে শ্রীলংকাকে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হলো। এসব বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালেই শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে বিপজ্জনক স্তরে চলে আসে। আমদানি করতে অসমর্থ হওয়ায় জ্বালানি তেল, এলএনজি, ভোজ্য তেল, চিনি, চাল এবং অন্যান্য নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি চরমাকার ধারণ করে, মানুষ রাস্তায় নেমে আসে রাজাপাকসে পরিবারের উৎখাতের দাবিতে। ২০২২ সালের এপ্রিলে রিজার্ভ মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ায় শ্রীলংকা নিজেকে ঋণখেলাপি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। শ্রীলংকার মত একদা-সমৃদ্ধ একটা অর্থনীতি যে এভাবে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে সেটাই অচিন্তনীয় ছিল দু’মাস আগে, অথচ বিশ্বকে এই অবিশ্বাস্য পতন প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে এখন। অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত জনগণ পুরো এপ্রিল মাস জুড়ে কলম্বোর রাজপথে রাজাপাকসে পরিবারের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের পদত্যাগের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু, মাহিন্দা রাজাপাকসের এক অবিমৃষ্যকারী ‘রাজনৈতিক গুন্ডামির’ কারণে গত ৯ মে সোমবার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন মারাত্মক সংঘাতপূর্ণ গণঅভ্যুত্থানে পর্যবসিত হলো, যেখানে একজন সংসদ-সদস্য সহ আটজন ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। আন্দোলনের তীব্রতায় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর মাহিন্দা তাঁর সমর্থকদেরকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাসে করে কলম্বোয় নিয়ে আসেন। এই ভাড়াটে গুন্ডারা বিনা উসকানিতে মাসাধিককাল ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জনতার উপর লাঠিসোটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে ও আরো বহু মানুষকে মারাত্মকভাবে আহত করে। এই হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার মানুষ ঘটনাস্থলে ছুটে আসে এবং গুন্ডাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এর জেরে সরকার-বিরোধী আন্দোলনকারীরা সরকার সমর্থকদেরকে গনপিটুনি দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য এবং রাজাপাকসে পরিবারের বাড়ীঘর আগুনে পোড়ানো শুরু করে দেয় এবং অনেককে মারধোরের পাশাপাশি পানিতে চুবানো শুরু করে। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল বাসভবনে জনতা ঢুকে পড়তে উদ্যত হলে মাহিন্দা এবং তার পরিবার হেলিকপ্টারে চড়ে সেখান থেকে ভেগে গিয়ে ত্রিনকোমালির একটি নৌবাহিনী ঘাঁটিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখন চলছে গোতাবায়ার গদি রক্ষার প্রাণপণ প্রয়াস, যা ব্যর্থ হওয়া প্রায় নিশ্চিত বলা চলে।

শ্রীলংকার এই চলমান গণ-অভ্যুত্থান থেকে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর জন্য অনেকগুলো শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও খামখেয়ালিপনা, পারিবারিক একনায়কতন্ত্র, হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজাপাকসে পরিবার দু’বছরের মধ্যেই শ্রীলংকার মত একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতিকে ধসিয়ে দিয়েছে এবং দেউলিয়া করে ফেলেছে। ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বেশ কয়েক বছর শ্রীলংকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার সাত শতাংশের বেশি হয়েছিল, কিন্তু ‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার’ এই নীতি রাজাপাকসে পরিবারের শাসনকে অবশ্যম্ভাবী পতনের দিকে ধাবিত করেছে, এবং শ্রীলংকার জনগণকেও দুর্দশার অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে। করোনা ভাইরাস মহামারি এই পতনকে তরান্বিত করেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু, শ্রীলংকার অর্থনৈতিক মহাসংকটের আলামতগুলো মহামারির বহু আগেই স্পষ্ট-দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। নির্বাচিত সরকার হলেই খামখেয়ালি স্বেচ্ছাচারিতার লাইসেন্স জনগণ কাউকে দেয় না। শ্রীলংকায় যেভাবে পরিবারতন্ত্র গেড়ে বসেছিল, অতটুকু না হলেও বাংলাদেশেও পরিবারতন্ত্র ও আত্মীয়তন্ত্র সরকারের ঘাটে ঘাটে ক্ষমতার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করছে, যা জনগণ মোটেও পছন্দ করে না। উপরন্তু, বিদেশী ঋণ পাওয়া গেলেই যথার্থ প্রকল্প-মূল্যায়ন ব্যতিরেকে কারো ইচ্ছামাফিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিণাম কখনোই শুভ হয়না। বাংলাদেশেও প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে যদি গ্ল্যামারাস ও স্বল্প-প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ অব্যাহত থাকে তাহলে শ্রীলংকার মত ঋণগ্রস্ততার ফাঁদে পড়তে বাংলাদেশেরও দেরি হবে না। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০২২ সালের ২৪ মে ৪২.৩৩ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে। ২০২০-২১ অর্থ-বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণ জিডিপি’র ৪২.৫ শতাংশ ছিল, কিন্তু এর মধ্যে জিডিপি’র ১৭.৫ শতাংশ ছিল ৬২.৪৩ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ। চলমান মেগা-প্রজেক্টগুলোর ব্যয়ের ধারাবাহিকতায় এখন বৈদেশিক ঋণ ৯১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

২০২১-২২ অর্থ-বছরের দশ মাসে বাংলাদেশের আমদানি গত বছরের চাইতে ৪৬ শতাংশ বেড়ে গেছে, যেটাকে আসন্ন মহাবিপদের ‘অশনি সংকেত’ আখ্যায়িত করাই সমীচীন। এই গতিতে আমদানি এল/সি খোলা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালের ৩০ জুন তারিখে ২০২১-২২ অর্থ-বছরের মোট আমদানি ৮২-৮৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। এর মানে, এই অর্থ-বছরের রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর প্রাক্কলন সত্ত্বেও অর্থ-বছরের শেষে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান অর্থ-বছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ২০-২১ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাবে। অতএব, এটা দেশের জন্য একটা বিপদ ডেকে আনছে। কারণ, আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টে এ-বছর প্রায় ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। লেনদেন ভারসাম্যের কারেন্ট একাউন্টে এত বড় ঘাটতি স্বাধীন বাংলাদেশে কখনো ঘটেনি। বরং, গত দুই দশক ধরে (গুটি কয়েক বছর ব্যতিরেকে) দেশের লেনদেন ভারসাম্যের কারেন্ট একাউন্টে উদ্বৃত্ত থাকাটাই নিয়মে পরিণত হয়েছিল। এর ফলে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে ২০০১ সালে মাত্র ১.০৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল সেখান থেকে গত দুই দশকে তা ক্রমাগতভাবে বেড়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। এবারের আমদানির বেলাগাম বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত দশ মাসে ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৪২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। আগামী মাসে রিজার্ভ আবারো কমে যাবে। সেজন্যই আমার আকুল আহ্বান, সময় থাকতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমদানিতে ওভার-ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে বিদেশে পুঁজিপাচার বেলাগাম গতিতে বেড়ে চলার কারণেই এত দ্রুত আমদানি বাড়ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী ব্যাপারটি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সামাল না দিলে অর্থনীতি গুরুতর বিপদে পড়বে।

করোনা ভাইরাস মহামারির তান্ডব কমতে না কমতেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং আগ্রাসনের মোকাবিলায় পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় ইউক্রেনের মরণপণ প্রতিরোধ সারা বিশ্বকে এক ভয়াবহ যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করেছে। সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। তেল, এলএনজি, রড, সিমেন্ট, ভোজ্যতেল, গম, ভুট্টাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে আগুন লেগে গেছে, জাহাজভাড়া বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। দেশের আমদানি ব্যয় ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধির পেছনে এটাও বড় কারণ। করোনা ভাইরাস মহামারি অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে আসায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি সঞ্চার হওয়ায় মূলধনী দ্রব্য আমদানিতেও বেশ কিছুটা গতি সঞ্চারিত হয়েছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু, আমদানি এল/সি বেলাগাম গতিতে বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ ওভার-ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে বিদেশে পুঁজিপাচার আবারো পুরোদমে শুরু হওয়া। করোনা ভাইরাস মহামারির সময়ে হুন্ডি পদ্ধতি বেশ খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছিল চাহিদা এবং সরবরাহ দু’দিক থেকেই। এর সুফল বাংলাদেশ পেয়েছে মহামারির দু’বছরে ফর্মাল চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণের জোয়ার সৃষ্টির মাধ্যমে। আমাদের রফতানি আয়ে করোনা ভাইরাস মহামারি কিছুটা ধস নামালেও আমদানির শ্লথগতি এবং রেমিট্যান্সের জোয়ার দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টে ঘাটতি সৃষ্টি হতে দেয়নি। বরং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল এই দু’বছর ধরে, যার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন আবার হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হয়ে উঠেছে। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম প্রায় ১০০ টাকায় উঠে গেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত আন্ত-ব্যাংক লেনদেনে ব্যবহৃত ডলারের দামের চাইতে বার টাকা বেশি। এই গ্যাপ কমাতে না পারলে হুন্ডির দাপট বাড়তেই থাকবে, ফর্মাল চ্যানেলের রেমিট্যান্সে যা ধস নামাবে। সাধু সাবধান!

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধটেকনাফে ৫ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য জব্দ