সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রী জনাব এম এ মান্নান মিডিয়ায় একটি সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন,‘হাওরে পাকা সড়ক বানিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছি’। দেশের জনগণের মধ্যে একজন সৎ, সজ্জন, মেধাবী, সরল ও স্পষ্টভাষী ব্যক্তি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জনকারী পরিকল্পনা মন্ত্রী যখন বিবেকের দংশনে এহেন সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে অপরাধবোধ থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইছেন তখন ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সাথে আলোচনা–বিশ্লেষণে নিয়ে আসা প্রয়োজন মনে করছি। হাওরে নির্মিত ইটনা–মিঠামইন–অষ্টগ্রামের সংযোগকারী প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন এই মহাসড়কটি ইতোমধ্যেই অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পর্যটক–আকর্ষণ হিসেবে ব্যাপকভাবে দেশে সমাদৃত হয়েছে। দেশের পত্র–পত্রিকায়, ব্রডকাস্ট মিডিয়ায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সড়কটি আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এটা উদ্বোধনের পর থেকেই। সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের কৃতিসন্তান জনাব মান্নানের এই খবরগুলো সবই জানা আছে। হাওরাঞ্চলের আরেক কৃতী সন্তান সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ প্রধানত এই প্রকল্পটি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে প্রভাবিত করেছেন। প্রথম দৃষ্টিতে এই মহাসড়কটিকে হাওরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক বিবেচনা করাই সংগত মনে হয়। কিন্তু, জনাব মান্নান এতদঞ্চলের সন্তান হিসেবে প্রকল্পটি যে জনগণের জন্য আখেরে উপকারের চাইতে অনেক বেশি অপকারী ও ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করবে তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। সেজন্যই তাঁর এই সরল স্বীকারোক্তি। তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। হাওরগুলোর বিপুল জলরাশির চলাচলের ক্ষেত্রে যে বর্ষামৌসুমে এই মহাসড়কটি বড় ধরনের বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে সেটা গত দু’তিন বছরে এলাকার জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছেন। মহাসড়কটি পানির নিম্নগামী প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করায় প্রত্যেক বর্ষাকালেই পুরো হাওরাঞ্চলের জনগণের অনেক ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ছে এবং অস্বাভাবিক বন্যার কবলে পড়ছে অনেকগুলো এলাকা। শুষ্ক মৌসুমে জনগণের চলাচলে সড়কটি প্রভূত উপকার বয়ে আনলেও এই মহা–অপকারটি জনগণকে মহা–ভোগান্তির শিকার করবে বছরের পর বছর। অথচ, এখন সড়কটি ভেঙে ফেলার বিষয়টিও আর সুবিবেচনাপ্রসূত মনে হবে না, সেজন্যই ‘পায়ে কুড়াল মারার’ কথাটি প্রযোজ্য হয়ে যাচ্ছে এক্ষেত্রে। এই বিষয়টি সামনে আসার কারণে ইতোমধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন যে হাওরাঞ্চলে আর কোন সড়ক নির্মাণ করা হবে না, প্রয়োজনে উড়ালসড়ক নির্মাণের ব্যবস্থা করা হবে।
যে কোন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সুচিন্তিতভাবে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ পরিচালনা এজন্যই অত্যাবশ্যক। প্রকল্পের উপকার–অপকার কী কী হতে পারে সেগুলো এহেন সম্ভাব্যতা–সমীক্ষাগুলোতে হাইলাইট করার কথা। সাধারণ জনগণের বিবেচনায় যে প্রকল্পকে খুবই প্রয়োজনীয় এবং উপকারী মনে হবে তা যে গভীরতর বিশ্লেষণে ক্ষতিকর হিসেবে ধরা দিতে পারে তারই বড়সড় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে হাওরের এই মহাসড়ক। পরিবেশকে জবরদস্তি করে পরিবর্তনের চেষ্টা করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় বলে যে কঠিন সত্য কথাটি আমরা অনেক সময় উপলব্ধি করি না তারই জের টানতে হবে হাওরাঞ্চলের জনগণকে আগামী দিনগুলোতে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে স্থাপিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটিও এরকম আরেকটি পরিবেশ–ধ্বংসকারী প্রকল্প, যেটাকে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে নির্মাণ শুরুর সময় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে ‘প্রেস্টিজিয়াস প্রকল্প’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সে সময়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে বিশ্বের জ্ঞানভান্ডার অতোখানি সমৃদ্ধ ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে তখনকার দিনে যথাযথ বিবেচিত ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ করেই প্রকল্পটি গৃহীত হয়েছিল। আশির দশকে আমার গবেষণার প্রয়োজনে যখন ঐ ‘ফিজিবিলিটি রিপোর্ট’ সংগ্রহ করে আমি পড়ার সুযোগ পাই তখন কয়েক পৃষ্ঠার ঐ রিপোর্টে জনপদ ও পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি তেমন গুরুত্ব না পাওয়ায় আমি বিষ্মিত হয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত যে এখনকার সময়ে এই প্রকল্পটি গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে না কোন ফিজিবিলিটি স্টাডি মোতাবেকই। এই কাপ্তাই বাঁধের কারণে পার্বত্য–চট্টগ্রামের প্রায় দেড় লাখ মানুষকে (তখনকার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক) বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছিল। প্রায় সাত’শ বর্গ–কিলোমিটার এলাকার বনাঞ্চল এবং চাষযোগ্য জমি ডুবে গিয়ে কাপ্তাই হ্রদের তলায় চলে গেছে। রাঙামাটি শহরটির প্রায় পুরো এলাকা কাপ্তাই হ্রদের গ্রাসে পতিত হয়েছে। প্রকল্পের অভিঘাতে পার্বত্য–চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠিীগুলোর প্রায় অর্ধেক অর্থনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছিল কোন রকম ক্ষতিপূরণ ছাড়াই। এদের অনেককে কাপ্তাই হ্রদের জেলে সম্প্রদায়ে পরিণত করা হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন জাতিগত বঞ্চনার পাশাপাশি কাপ্তাই প্রকল্পের শিকার হওয়ার কারণেই এতদঞ্চলে বিংশ শতাব্দীর সত্তর এবং আশির দশকে পাহাড়ী জনগণের অংশগ্রহণে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়েছিল, শান্তি চুক্তি সত্ত্বেও যা আজো শেষ হয়নি। প্রায় পঁয়ষট্টি বছর ধরে কাপ্তাই প্রকল্পের ক্ষতিকারক অভিঘাতগুলোকে মেনে নিতে হচ্ছে পার্বত্য–চট্টগ্রাম এবং সারা বাংলাদেশের জনগণকে। কারণ, এখন তো আর প্রতিকারের সুযোগ নেই! সেজন্যই খামখেয়ালের বশবর্তী হয়ে মেগা–প্রকল্প গ্রহণের বদ–খাসলত থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিরত রাখার জন্য আমাকে প্রায়ই কলম ধরতে হচ্ছে। নিচে এরকম স্বল্প–প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় কয়েকটি মেগা–প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যতের নেতিবাচক অভিঘাত তুলে ধরছি।
প্রথমেই আসবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রসঙ্গ। প্রায় এক লক্ষ তের হাজার বিরান্নব্বই কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে মাত্র ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই নির্মীয়মাণ প্ল্যান্ট প্রকল্প–মূল্যায়নের (project evaluation) পদ্ধতি প্রয়োগ করে কখনোই গ্রহণযোগ্য (feasible) প্রমাণ করা যাবে না, কারণ ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেকগুলো বিকল্প প্রযুক্তি বিশ্বে পাওয়া যাবে যেখানে এর অর্ধেকেরও কম ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পে ঐ পরিমাণ বিদ্যুৎ অনেক বেশি নিরাপদে উৎপাদন করা যাবে। রাশিয়া থেকে এই প্রকল্পের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়া গেছে, অথচ ভারতের তামিলনাড়ুর কুদনকুলামে রাশিয়ার ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণে ২০০০ মেগাওয়াটের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এই ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণের লোভে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প বাংলাদেশ কেন গ্রহণ করল? কেউ কেউ বলছেন, যেহেতু বঙ্গবন্ধু একটি পারমাণবিক প্রকল্পের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাই তাঁর কন্যা এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। তবুও প্রশ্ন উঠবেই পারমাণবিক প্রকল্পের মত একটা মহাবিপজ্জনক প্রযুক্তির প্ল্যান্ট বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের সীমানার একেবারে মাঝখানে পাবনার রূপপুরে স্থাপিত হওয়া আদৌ কি গ্রহণযোগ্য? পারমাণবিক প্ল্যান্টের দুর্ঘটনা খুব বিরল নয়। প্রধানমন্ত্রীর জীবদ্দশায় বড় কোন দুর্ঘটনা না–ও ঘটতে পারে, কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত বৈজ্ঞাানিক সত্য হলো একটু অসাবধান হলেই পারমাণবিক প্ল্যান্ট থেকে বিপজ্জনক বিকিরণ বেরিয়ে যেতে পারে যা প্ল্যান্টের আশেপাশের এলাকার জনগণের জন্য মারাত্মক জীবন–সংহারী স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করবে। বলা হচ্ছে, প্রকল্প চালু হওয়ার ২০ বছরের মধ্যেই রাশিয়ার ঋণ সুদাসলে শোধ হয়ে যাবে। এই প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় প্রাক্কলিত ১৩৫০ কোটি ডলারের চাইতে না বাড়লেও ‘গরীবের এই ঘোড়ারোগ’ কখনোই প্রশংসনীয় বিবেচিত হবে না, রাশিয়া থেকে ঋণ পেয়েছি বলেই এহেন ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প নেয়া কখনোই যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করা যাবে না। এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিলে ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ব্যয় রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের মোট ব্যয়ের অর্ধেকও হতো না। অথচ, সৌরবিদ্যুৎ সবচেয়ে পরিবেশ–বান্ধব এবং ঝুঁকিমুক্ত প্রযুক্তি। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত, এক ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ইতোমধ্যেই গণচীন, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডে বাংলাদেশী দশ টাকার নিচে নেমে এসেছে। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে অনেক খালি জায়গা লাগে বিধায় বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে তা উৎপাদন সম্ভব নয় বলে যে ধারণা রয়েছে তা–ও ঠিক নয়। দেশের সমুদ্র–উপকূল এবং নদী ও খালগুলোর দু’পারে সোলার প্যানেল স্থাপনের সম্ভাবনাটি খতিয়ে দেখা হোক্। সম্প্রতি জার্মানি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে বাংলাদেশকে বিপুলভাবে আর্থিক ও কারিগরী সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ার একটি নিউজ–ক্লিপ জানিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশে জমির তুলনামূলক স্বল্পতার প্রকৃত সমাধান পাওয়া যাবে যদি দেশের বিশাল সমুদ্র–উপকুলে একইসাথে সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়।
দ্বিতীয় যে প্রকল্পটি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের জনগণের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো ঢাকায় নির্মীয়মাণ বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প। ১২ বছর ধরে এই প্রকল্পটি চলমান, ইতোমধ্যেই প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় চারগুণ খরচ হয়ে গেছে এই প্রকল্পে। পাঁচজন লোকের প্রাণও গেছে এই প্রকল্পের নির্মাণ–দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। এই প্রকল্পের জন্য ১২ বছর ধরে এয়ারপোর্ট রোড ব্যবহারকারী জনগণকে কী বিপুল ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে সেটা ভুক্তভোগী কাউকে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বলা হচ্ছে এই বছরের মধ্যেও প্রকল্পটি শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আরো দুঃখজনক হলো, এখন স্বীকার করা হচ্ছে যে প্রকল্পটি প্রকৃত বিচারে ঢাকার জনগণের চলাচলের ভোগান্তিকে তেমন প্রশমিত করতে পারবে না। বিশ্বের কয়েকটি দেশের বড় নগরীতে বাস র্যাপিড ট্রানজিট বাস্তবায়িত হলেও ঘনবসতিপূর্ণ মেগা–সিটির জন্য এহেন প্রকল্প নাকি তেমন উপযোগী প্রমাণিত হয়নি!
তৃতীয় যে কম–প্রয়োজনীয় প্রকল্পের উল্লেখ করবো সেটা হলো ঢাকা–ফরিদপুর–যশোর রেললাইন। পদ্মাসেতু দিয়ে মহাসড়কের মাধ্যমে ঢাকার সাথে দক্ষিণবঙ্গের সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই রেললাইন অনেকখানি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। অথচ, প্রায় একচল্লিশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে! যমুনা রেলসেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে বর্তমান বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর রেলপথের সীমাবদ্ধতা দূর হয়ে যাবে। চতুর্থ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প। পত্র–পত্রিকায় প্রায়ই খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে প্রথম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের দুই–তৃতীয়াংশ ক্যাপাসিটি এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। আমরা নিজেরাও ব্যবহার করতে পারছি না, অন্য কোন দেশের কাছে এই স্যাটেলাইটের উদ্বৃত্ত ক্যাপাসিটি বিক্রয়ও করতে পারছি না। অথচ, এখন কৃষিখাতে ব্যবহারের অজুহাত দিয়ে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের তোড়জোর চলেছে! বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এটার প্রয়োজন প্রশ্নবিদ্ধ। পঞ্চম যে প্রকল্পটি স্বল্প–প্রয়োজনীয় প্রমাণিত হবে সেটি হলো চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নিমীয়মাণ রেলপথ, এটাও বেশ কয়েক বছর আন্ডার–ইউটিলাইজড থেকে যাবে।
এ–পর্যায়ে যে আরেকটি প্রকল্প–ক্যাটেগরির নজির তুলে ধরা প্রয়োজন সেটি হলো যত্রতত্র সেতু ও সড়ক নির্মাণের সংস্কৃতি। নব্বই দশকে ডঃ ইউনূস বাংলাদেশকে ‘অসমাপ্ত ও অর্ধ–সমাপ্ত প্রকল্পের কবরস্থান’ আখ্যায়িত করেছিলেন এসব সেতু ও সড়কের সংখ্যাধিক্যের বিচারে। বিপুলসংখ্যক সেতু দেশের বিভিন্নস্থানে অসমাপ্ত ও অর্ধ–সমাপ্ত অবস্থায় এখনো ব্যবহার–অযোগ্য হয়ে পড়ে রয়েছে, অথচ স্থানীয় সংসদ–সদস্য ও ক্ষমতাসীন দল বা জোটের জনপ্রতিনিধিদের প্রথম অগ্রাধিকার বিবেচিত হয়ে চলেছে তাঁদের নির্বাচনী এলাকার সেতু–নির্মাণ ও সড়ক–উন্নয়ন। এমন অনেক সেতুর ছবি নিয়মিতভাবে পত্র–পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যেগুলোর সাথে কোন সংযোগ–সড়কের ব্যবস্থাই গড়ে তোলা হয়নি নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার বছরের পর বছর পার করেও। (অনেক সড়ক ও সেতু–নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর বহুদিন চালু হয় না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের তারিখ দিতে না পারায়)! আমরা অনেকেই জানি না যে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতি বর্গ–কিলোমিটারে সবচেয়ে বেশি দৈর্ঘ্যের অপরিকল্পিত সড়কপথ রয়েছে (বেশির ভাগই কাঁচা রাস্তা)। এভাবে যত্রতত্র সড়ক নির্মাণ করে আমরা বিভিন্ন নগরীর ও গ্রামীণ জনপদের পানি–নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে জলাবদ্ধতা সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছি। উদাহরণ হিসেবে বলছি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মারাত্মক জলাবদ্ধতা সমস্যার জন্য এই দুটো মহানগরীর খালগুলোকে জবরদখল ও ভরাট করে ফেলাকেই প্রধানত দায়ী করা হয়ে থাকে। আমরা যারা চট্টগ্রাম নগরীতে কৈশোর থেকে বসবাস করছি তাদের কাছে চট্টগ্রামের ড্রেনেজ সিস্টেমের এহেন দুরবস্থা খুবই হাস্যকর মনে হয়। এখন আবার হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে এই জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রয়াস চলেছে!
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়