৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। ২০০৯–২০২৪ পর্বে বঙ্গবন্ধু–কন্যা হাসিনা সাড়ে পনেরো বছরের শাসনকালে বাংলাদেশে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ এবং ‘ক্লেপ্টোক্রেসির’ এক ন্যক্কারজনক লুটপাটতন্ত্র কায়েম করেছিলেন, যা স্বাধীনতা–উত্তর ৫৪ বছরের পুঁজি–লুন্ঠনের ধারাবাহিকতাকে চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থকদের মধ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেড়ে রয়েছে যে হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরশাসনের মেয়াদকালে দেশের অর্থনীতি প্রশংসনীয় গতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কিন্তু, একজন নির্মোহ উন্নয়ন–গবেষক হিসেবে তাদেরকে বলতে চাই, আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক উন্নয়নের খেসারত হলো আঠারো লক্ষ কোটি টাকা ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভুয়া বয়ান সৃষ্টির পাশাপাশি বেলাগাম পুঁজি–লুন্ঠন ও বিদেশে পুঁজি পাচারের এক অবিশ্বাস্য রেকর্ড সৃষ্টি। হাসিনার স্বৈরশাসনকালে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হয়েছিল সেটা ছিল ঋণ করে ঘি খাওয়ার ক্লাসিক উদাহরণ, ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে হাসিনা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। হাসিনা স্বৈর–শাসনামলে তাঁর পরিবার, আত্মীয়–স্বজন, দলীয় নেতা–কর্মী, কতিপয় অলিগার্ক–ব্যবসায়ী এবং পুঁজি–লুটেরাদেরকে সাথে নিয়ে সরকারী খাতের প্রকল্প থেকে যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুন্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন তার ভয়াবহ কাহিনী তাঁর পতনের পর উদ্ঘাটিত হতে শুরু করেছে। ৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দৈনিক বণিক বার্তার হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্য–উপাত্তের দাবি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র দুই লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার আট’শ ত্রিশ কোটি টাকা। এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির অংকের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে পনেরো লক্ষ আটান্নো হাজার দুই’শ ছয় কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতি বছর মাথাপিছু জিডিপি’র উচ্চ–প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে বলা চলে ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ ও জনগণের সাথে ভয়ানক প্রতারণা।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখের দৈনিক প্রথম আলোর হেডলাইন খবর ‘বিশ্বে অতি ধনীর উত্থানে শীর্ষে বাংলাদেশ’ প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে জানানো হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র–ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’ এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট–২০১৮ এর গবেষণা মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করে নিয়েছিল বাংলাদেশ। ঐ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছিল ১৭.৩ শতাংশ হারে। ঐ গবেষণা প্রতিবেদনে ত্রিশ মিলিয়ন ডলারের (প্রায় ৩৬৫ কোটি টাকা) বেশি নীট–সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদেরকে ‘আল্ট্রা–হাই নেট–ওয়ার্থ’ (ইউএইচএনডব্লিউ’) ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে অভিহিত করে বলা হয়েছে, বিশ্বে মোট ২৫৫,৮৫৫ জন ইউএইচএনডব্লিউ ইন্ডিভিজুয়ালের সবচেয়ে বেশি ৭৯,৫৯৫ জন রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জাপান, তাদের ধনকুবেরের সংখ্যা ১৭,৯১৫ জন। তৃতীয় থেকে দশম স্থানগুলোয় রয়েছে গণচীন (১৬,৮৭৫ জন ধনকুবের), জার্মানী (১৫,০৮০ জন ধনকুবের), কানাডা (১০,৮৪০ জন ধনকুবের), ফ্রান্স (১০,১২০ জন ধনকুবের), হংকং (১০,০১০ জন ধনকুবের), যুক্তরাজ্য (৯,৩৭০ জন ধনকুবের), সুইজারল্যান্ড (৬,৪০০ জন ধনকুবের) ও ইতালী (৫,৯৬০ জন ধনকুবের)। অন্য দেশগুলোর ধনকুবেরের সংখ্যা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। এই ২৫৫,৮৫৫ জন ধনকুবেরের সংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিল ১২.৯ শতাংশ, কিন্তু তাদের সম্পদবৃদ্ধির হার ছিল ১৬.৩ শতাংশ। তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়ে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছিল ৩১.৫ ট্রিলিয়ন (মানে সাড়ে একত্রিশ লক্ষ কোটি) ডলারে। ঐ পাঁচ বছরে ধনকুবেরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছিল গণচীনে ও হংকং–এ, কিন্তু ধনকুবেরের সংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ১৭.৩ শতাংশ বাংলাদেশে। এদেশে ঐ সময় মোট ৩৫৫ জন ধনকুবের ছিল বলে জানিয়েছিল ঐ প্রতিবেদন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ইতিহাসে ওখানে যেভাবে ‘রবার ব্যারনদের’ উত্থান ঘটেছিল তার সাথে বাংলাদেশের এই ৩৫৫ জন ধনকুবেরের উত্থানের প্রচুর মিল পরিলক্ষিত হওয়ায় তাদেরকেও আমি ‘রবার ব্যারন’ অভিহিত করতে চাই।
ইন্টারনেটে উইকিপিডিয়ায় সার্চ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়—১৮৭০ সাল থেকে ১৯১৪ সালের পুঁজিবাদী বিকাশে ‘রবার ব্যারন’দের ভূমিকার বর্ণনা পাওয়া যাবে, যার সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা–উত্তর ৫৪ বছরের রাঘববোয়াল পুঁজিলুটেরাদের অবিশ্বাস্য ধনসম্পদ আহরণের পদ্ধতির আশ্চর্যজনক মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। এই অভিধাটি যেসব মার্কিন ধনকুবেরদের ধনসম্পদ আহরণের বৈশিষ্ট্য বর্ণনার জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে সেসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তাদের দুর্বৃত্তায়িত ব্যবসা–কৌশল (রবার) এবং তদানীন্তন মার্কিন রাজনীতির ওপর তাদের অপরিসীম প্রভাবের কারণে তাদের সামাজিক প্রতিপত্তিকে (ব্যারন) ফোকাস করা হয়েছে। এরকম ১৯ জন ধনকুবের ‘রবার ব্যারন’ ছিলেন জন ডি রকফেলার, কর্নেলিয়াস ভেন্ডারবিল্ট, এন্ড্রু কার্নেগী, এন্ড্রু মেলন, জন জ্যাকব এষ্টর, জে কুক, জেমস বুখানান ডিউক, জে পি মর্গান, হেনরী মরিসন ফ্ল্যাগলার, হেনরী হাটলস্টন রজার্স, জন সি অসগুড, চার্লস এম শোয়াব, চার্লস ক্রকার, মার্শাল ফিল্ড, হেনরী ক্লে ফ্রিক, ড্যানিয়েল ড্রু, জে গ্যুল্ড, জেমস ফিস্ক এবং লেলান্ড ষ্ট্যানফোর্ড। তাঁদের বেশিরভাগই প্রতিপক্ষের প্রতি ছিলেন অতি কঠোর। তাঁরা ঠিকমত সরকারের কর দিতেন না। তাঁদের ধনসম্পদের আহরণ পদ্ধতি ছিল দুর্বৃত্তায়িত। ১৮৭০–১৯১৪ পর্যায়ে তাঁরা মার্কিন রাজনীতিকে প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। আজকের দিনের বিশ্ববিখ্যাত বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাঁদের বেশ কয়েকজন। কিন্তু, ধনকুবের হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের অনেকেই শেষ জীবনে ধনসম্পদ বিভিন্ন জনহিতকর কাজে দান করে গেছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে গেছেন, ট্রাস্ট স্থাপন করে ধনসম্পদ দাতব্য কর্মে ব্যয়ের ব্যবস্থা করে গেছেন। আমি যে ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছিলাম সেটি কর্নেলিয়াস ভেন্ডারবিল্টের অর্থ–বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, অথচ জীবদ্দশায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কুখ্যাত কর–ফাঁকিবাজ হিসেবে এই শিপিং টাইকুনের ভারি বদনাম ছিল। এখনো ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সন্তানদের ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষারই যোগান দিয়ে চলেছে। সেজন্যেই বলা হয় পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার ক্রমবর্ধমান রমরমার একটি অবশ্যম্ভাবী পর্যায় হলো এহেন ‘রবান ব্যারনদের’ ক্রমবর্ধমান পুঁজি আহরণ, বেধড়ক পুঁজি লুন্ঠন ও ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে যে আয় ও সম্পদ ক্রমেই একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হয়ে যায় তারই অকাট্য প্রমাণ হলো বাংলাদেশেও ধনকুবের রবার ব্যারনদের সংখ্যার ১৭.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির খবর। ২০০১–২০০৫ ঐ পাঁচ বছরে পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেছিল, আবার বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করলো ধনকুবেরের সংখ্যাবৃদ্ধির দৌঁড়ে। অথচ, ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ নাকি আবারো ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’! এসব ‘রবার ব্যারন’ সৃষ্টির জন্যে কি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম আমরা? ধিক্ এহেন রাজনীতিকে!
স্বৈরশাসক হাসিনার শাসনামলে ধনকুবেরদের দেশে–বিদেশের সম্পদের প্রবল স্ফীতি ঘটানোর অর্থই হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফলের সিংহভাগ ঐ আমলে দেশের ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর কাছে গিয়ে জমা হয়ে যাচ্ছিল। সোজা কথায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে দেশের শ্রমজীবী জনগণ বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছিল দেশের ক্ষমতাসীন মহলের মারাত্মক ভ্রান্ত নীতির কারণে। দেশের আয় এবং সম্পদের এহেন মারাত্মক পুঞ্জীভবন শেখ হাসিনার সরকারের ‘জনগণের সরকার’ দাবিকে মুখ ভ্যাংচাচ্ছিল, এবং বঙ্গবন্ধু–কন্যার রাজনীতিকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ নিকৃষ্টতম নজির হিসেবে সারা বিশ্বের জনগণের কাছে উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক–বাহক বলে দাবিদার দল আওয়ামী লীগের জন্যে এই শিরোপা ছিল অত্যন্ত লজ্জাজনক একটি শিরোপা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূল নীতির মধ্যে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র আবার পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ২০১১ সালে সংসদে পাশ হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে হাসিনার সরকার সে রায়কে সংবিধানে ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু, আমি বারবার জাতিকে জানিয়ে যাচ্ছিলাম যে পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করা সত্ত্বেও হাসিনার সরকার ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে মেতে ছিল, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম নীতি–প্রণেতাদের ধ্যান–জ্ঞান হিসেবে ‘হলি রীটের’ মর্যাদায় বহাল রয়ে গিয়েছিল।
১৯৭৫ সাল থেকে এদেশের সরকারগুলো ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ ডামাডোলে শরীক হয়ে ব্যক্তি খাত ও বাজারিকরণকে আঁকড়ে ধরার ফলে এদেশে আয় ও সম্পদ বন্টনের বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে। ১৯৭৩ সালে বিআইডিএস এর গবেষণায় নির্ণীত হয়েছিল যে বাংলাদেশের আয় বৈষম্য পরিমাপক জিনি (বা গিনি) সহগ ০.৩৬। ২০২২ সালে এসে জিনি সহগ ০.৪৯৯ এ পৌঁছে গেছে। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানে ২২টি কোটিপতি পরিবারের কথা বলা হতো, যারা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের শিল্প–বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ঐ ২২ পরিবারের মধ্যে দুটো পরিবার ছিল পূর্ব পাকিস্তানের, তা–ও একটি ছিল অবাঙালি। ঐ বাংলাদেশেই ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব মোতাবেক ২৩,২১২ জন কোটিপতি ছিল। ২০১৪ সালে তারা ঐ সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার অতিক্রম করেছে বলে দাবি করেছিল। ২০২৫ সালে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ একাউন্টে থাকা ব্যাংকের আমানতকারীর সংখ্যা এক লাখ পঁচিশ হাজার অতিক্রম করেছে। এসব তথ্যের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল যে একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির কাছে গিয়ে পুঞ্জীভূত হয়ে যাওয়ার কিংবা তাদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার বিপদ সংকেত পাওয়া যাচ্ছিল সে ব্যাপারে সাবেক সরকারের কি কোন করণীয় ছিল না? সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় এই বিপদটার জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো: ১) দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতাপিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে; ২) দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩) ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপী বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৪) দেশের জায়গা–জমি, এপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচন্ডভাবে বেড়েছে; ৫) বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মক ভাবে বাড়ছে; ৬) ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা এক কোটি পঁচাত্তর লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ বা ৭০ লাখ মানুষ বস্তিবাসী; ৭) দেশে গাড়ী, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ী আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯) বিদেশে বাড়ীঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০) ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১) উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার খায়েশ বাড়ছে; ১২) উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘনঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩) প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫) দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মোচ্ছব চলছে; ১৬) প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে; এবং ১৭) দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে পদে পদে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
স্বৈরশাসক হাসিনার পতনের পর এসব রবার ব্যারনরা গত সাড়ে সাত মাসে কেমন আছেন জানতে ইচ্ছা করে। হাসিনার সময় অলিগার্ক হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণের কাছে ঘৃণ্য–পরিচিতি অর্জনকারী রবার ব্যারন কয়েকজন ইতোমধ্যেই হয় গ্রেফতার হয়েছেন নয়তো দেশ থেকে ভেগে গেছেন। তবে, বেশিরভাগ রবার ব্যারনই হয়তো দেশের মধ্যে আত্মগোপন করে আছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রবার ব্যারনদের ব্যাপারে কী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছে সেটা এখনো পরিষ্কার হয়নি। ‘বৈষম্যবিরোধী উন্নয়নের ধারক’ হতে হলে এ–ব্যাপারে সরকারের অবস্থান অচিরেই জানান দিতে হবে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়