ড. মইনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৭:৫৯ পূর্বাহ্ণ

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে। আগস্টের ২৯ তারিখে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস ডঃ দেবপ্রিয় ভট্টচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। কমিটিকে সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরশাসনে বাংলাদেশের অর্থনীতির হালহকিকত গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিটি গত ১ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে প্রফেসর ইউনূসের কাছে তাদের শ্বেতপত্রটির খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। শ্বেতপত্রটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘উন্নয়ন বয়ানের ব্যবচ্ছেদ’ (ডিসসেকশান অব এ ডেভেলাপমেন্ট নেরেটিভ)। প্রায় ৩৯৬ পৃষ্ঠার খসড়া রিপোর্টে নাকি চব্বিশটি অধ্যায় রয়েছে। ডঃ দেবপ্রিয় হাসিনার শাসনামলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘চামচা পুঁজিবাদ’ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) থেকে সরাসরি ‘চোরতন্ত্রে’ (ক্লেপ্টোক্রেসি) রূপান্তরিত হওয়ার দাবি করেছেন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসার কয়েকদিন পর শেখ হাসিনার একটা বক্তব্য ছিল,‘বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদেরকে দু’হাতে টাকা বানাতে হবে’। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের পুত্র সোহেল তাজ সম্প্রতি হাসিনার এই মন্তব্যটির উদ্ধৃতি দিয়ে দেশের মিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তখন সোহেল তাজ ছিলেন হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। ২০০৯ সালের মে মাসে সোহেল তাজ পদত্যাগ করেছিলেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরশাসন হাসিনাকে সুযোগ করে দিয়েছিল বেলাগাম লুটপাট করতে। হাসিনা তাঁর স্বৈরাচারী শাসনামলে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতাকর্মী, কতিপয় অলিগার্কব্যবসায়ী এবং পুঁজিলুটেরাদেরকে সাথে নিয়ে সরকারী খাতের প্রকল্প থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুন্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। এই পুঁজিলুন্ঠনের কেন্দ্রে ছিল হাসিনাপুত্র জয়, রেহানাকন্যা টিউলিপ ও রেহানাপুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী ববি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও তার পুত্র শেখ ফাহিম, শেখ হেলাল, তাঁর ভাই শেখ জুয়েল ও তাঁর পুত্র শেখ তন্ময়, সেরনিয়াবাত হাসনাত আবদুল্লাহ ও তাঁর পুত্র সাদিক আবদুল্লাহ, শেখ তাপস, শেখ পরশ, লিটন চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরী এবং হাসিনার অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। আর ছিল এস আলম, সালমান রহমান, সামিটের আজিজ খান, বসুন্ধরার আকবর সোবহান, ওরিয়ন গ্রুপের ওবাইদুল করিম ও নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের মত লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার লুটেরা রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ আমলা। অতি সম্প্রতি হাসিনার উপদেষ্টা সালমান রহমান রিমান্ডে স্বীকার করেছে, এস আলম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে দেড় লক্ষ কোটি টাকার বেশি লুট করেছে তার অর্ধেকটাই দিতে হয়েছে জয় ও টিউলিপকে! সালমান রহমান নিজেও তার মালিকানাধীন বেক্সিমকোর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি, যে দায় এখন পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে যে দেশের চলমান ৮২টি প্রকল্পে শেখ হাসিনার কোন না কোন আত্মীয়স্বজন জড়িত রয়েছে, যেগুলোর প্রকল্পব্যয় একান্ন হাজার কোটি টাকার বেশি। আওয়ামী লীগের প্রায় সকল মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চস্তরের নেতাকর্মী এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও গত সাড়ে পনেরো বছরে কোন না কোনভাবে দুর্নীতি ও পুঁজিলুন্ঠনে জড়িয়ে গিয়েছিল। সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নাকি শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়ে নাকি তাঁর আরো অনেক বাড়িঘর রয়েছে। জনমনে একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছে। পুরো ব্যাপারটিই এখন ভুয়া প্রমাণিত হচ্ছে। হাসিনার পতিত সরকার ‘ডেটা ডক্টরিং’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে দেশটাকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছে, যে অর্থের সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, পুঁজিলুন্ঠন ও পুঁজিপাচারকে ছড়িয়ে দিয়ে হাসিনা উন্নয়নের এই ‘মিথ্যা বয়ান’ রচনা করেছেন, যার প্রকৃত রূপটি শ্বেতপত্রে ফুটে উঠেছে। ১ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে সরকারের কাছে জমা দেওয়া শ্বেতপত্রটির নানা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইতোমধ্যেই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। শ্বেতপত্রটির পূর্ণাঙ্গ অবয়ব এখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি সাধারণ জনগণের। তবুও বলব, প্রকাশিত অংশগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে, শ্বেতপত্রটি সত্যিকারভাবেই স্বৈরশাসক হাসিনার কথিত উন্নয়ন বয়ানের আড়ালে লুক্কায়িত ‘অবিশ্বাস্য লুটপাটতন্ত্রের একটি নির্মোহ ব্যবচ্ছেদের দলিল’ হিসেবে দেশের ইতিহাসে স্থান করে নেবে। নিচে ইতোমধ্যেই প্রকাশিত শ্বেতপত্রের প্রধান দিকগুলো বর্ণনা করছি:

) শ্বেতপত্র কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের লুটপাটতন্ত্রের মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসেবে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুন্ঠিত হয়ে দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি লুন্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফাইনেন্সিয়াল খাত, তারপর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত, তারপর ভৌত অবকাঠামো খাত এবং এরপর তথ্য প্রযুক্তি খাত। শ্বেতপত্রে খাতওয়ারী লুন্ঠনের তথ্যউপাত্ত উদঘাটন করে লুন্ঠিত অর্থের প্রাক্কলন প্রকাশ করা হয়েছে। শ্বেতপত্রে মোট ২৮টি দুর্নীতির পদ্ধতির মাধ্যমে লুন্ঠন প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণে নিয়ে আসা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত এবং কয়েকটি ‘ট্যাক্স হেভেন’ সবচেয়ে বেশি অর্থপাচারের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। লুটেরা রাজনীতিবিদদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় অলিগার্ক ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের খেলোয়ার, দুর্নীতিবাজ আমলা, ঠিকাদার ও মধ্যস্বত্বভোগী, হাসিনার আত্মীয়স্বজন এবং ‘ইনফ্লুয়েন্স প্যাডলার’ ও ‘হুইলারডিলাররা’ এই লুটপাটতন্ত্রের প্রধান খেলোয়াড়। এই লুটেরারা পারষ্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে দেশের নির্বাহী বিভাগ, সিভিল প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহ, সরকারী রাজস্ব আহরণ বিভাগসমূহ ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণকারী বিভাগসমূহকে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফায়দা হাসিলের অংশীদার করে ফেলেছে। দেশের বিনিয়োগ ও রাজস্ব আহরণকে এরা দুর্বল করে ফেলেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস নামিয়েছে, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনকে তছনছ করে দিয়েছে।

) কানাডায় ৪৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। দুবাইয়ে ৯৭২ জন বাংলাদেশীর রিয়াল স্টেট সম্পত্তি রয়েছে, মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ কার্যক্রমে ঘরবাড়ি কিনেছে ন্যূনপক্ষে ৩,৬০০ জন বাংলাদেশী।

) সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে প্রতি বছর গড়ে ২৩ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ আত্মসাৎ হয়েছে।

) সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী মোস্তফা কামালের নির্দেশে ২০১৪ সাল থেকে ‘ডেটা ডক্টরিং’ এর কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর জিডিপি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, একইসাথে মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখানোর জন্য দেশের মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে। দেশের রফতানি আয়কে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হারকে সবসময় কমিয়ে দেখানো হয়েছে। দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যাকে কম দেখানো হয়েছে, যাতে দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের সাফল্যকে বাড়িয়ে দেখানো যায়। দেশের জনগণের জন্মহার ও মৃত্যুহারকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো যায়। একইসাথে দেশের ‘টোটাল ফার্টিলিটি রেটকে’ কম দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকার সফল হচ্ছে প্রচার করা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩২৪ অর্থবছরে রফতানি আয় আগের বছরে সাবেক সরকার যতখানি দেখিয়েছিল তার চাইতে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার ১.৩ শতাংশে নেমে গেছে বলে সাবেক সরকার দাবি করলেও তা প্রকৃতপক্ষে আরো বেশি। দারিদ্র্য সীমার নিচে জনসংখ্যার হার ১৮ শতাংশে নেমে গেছে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এই হার অনেক বেশি। আরো গুরুতর হলো, এই দারিদ্র্যহার টেকসই নয়। মাসে দু’দিন কাজ না পেলে দেশের দুই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায় বলে দাবি করেছে শ্বেতপত্র কমিটি।

) দেশের সাতটি মেগাপ্রকল্পের ব্যয় প্রাথমিক প্রাক্কলনের চাইতে ৭০ শতাংশ বাড়িয়ে অর্থ লুটপাট করা হয়েছে, যার আনুমানিক পরিমাণ ৮০, ৫৬৯ কোটি টাকা। এই মেগাপ্রকল্পগুলো হচ্ছে: পদ্মা সেতু প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প, ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকামাওয়াযশোরপায়রা রেলপথ প্রকল্প, চট্টগ্রামদোহাজারিকক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প, পায়রা বন্দর প্রকল্প এবং মাতারবাড়ি কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলোর যথাযথ ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ এবং ‘কস্টবেনিফিট এনালাইসিস’ না করার কারণে এই ৭০ শতাংশ ব্যয়বৃদ্ধির অজুহাত সৃষ্টি হয়েছে।

) দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপিঋণের পরিমাণ পৌনে সাত লক্ষ কোটি টাকা। শ্বেতপত্র কমিটি প্রকৃত খেলাপিঋণকে ‘ডিসট্রেসড এসেট’ নামে অভিহিত করেছে। শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়েছে যে এই ‘ডিসট্রেসড এসেট’ দিয়ে ১৩.৫টি ঢাকা মেট্রোরেল কিংবা ২২.৫টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেতো। অবৈধ হুন্ডি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৩.৪ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। দশটি ব্যাংক ‘টেকনিক্যালি দেউলিয়া’ হয়ে গেছে, যেগুলোর মধ্যে দুটো ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত আর বাকি আটটা ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক। এগুলোতে তারল্যসংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক জনতা ব্যাংক ও বেসিক বড় ধরনের ঋণ লুটপাটের শিকার। দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংকঋণ লুটেরা ইসলামী ব্যাংক ও অন্য শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে।

) দেশের শেয়ার বাজার থেকে কমপক্ষে ২৭ বিলিয়ন ডলার সরাসরি আত্মসাৎ করা হয়েছে। নানা রকম কারসাজির মাধ্যমে শেয়ার বাজার থেকে এক ট্রিলিয়ন টাকারও (এক লক্ষ কোটি) বেশি লুটপাট করেছে কয়েকজন চিহ্নিত খেলোয়াড়। ২০১০১১ সালের শেয়ার বাজারের পরিকল্পিত ধসের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটির রিপোর্টকে কোন পাত্তা দেওয়া হয়নি, যেজন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে হারিয়ে ফেলেছে।

) দেশের জনগণের আয়বৈষম্যপরিমাপক জিনি সহগ ২০২২ সালে ০.৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে। বিশ্ব ব্যাংকের জরিপে যে ৭২টি দেশ তাদের আয়বৈষম্য রিপোর্ট করেছে তার মধ্যে এর চাইতে বেশি জিনি সহগের মান ব্রাজিল, কলম্বিয়া এবং পানামাএই তিনটি দেশে বিদ্যমান। তার চাইতেও ভয়াবহ অবস্থানে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের সম্পদ বৈষম্যের পরিমাপক জিনি সহগ, ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সালে যেটা ০.৮২ থেকে ০.৮৪ এ পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশ এখন একটি মারাত্মক উচ্চ আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্যের দেশ।

) দেশের মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হারকে ১৯৯৫ সাল থেকে কয়েক শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে, যেজন্য উন্নয়ন অর্থনীতিবিদদের অনেকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ‘প্যারাডক্স’ আখ্যায়িত করেছেন। পতিত স্বৈরাশাসকের পতনের পর ২০২৪২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাবেক সরকারের প্রক্ষেপিত ৬.৫ শতাংশের চাইতে কমে ৫.৮ শতাংশে এসে দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে।

১০) শ্বেতপত্রে আনুমানিক ৭৭,০০০ কোটি থেকে ৯৮,০০০ কোটি টাকা ঘুষদুর্নীতির মাধ্যমে সরকারীকর্মকর্তাদের কব্জায় চলে গেছে বলা হয়েছে, এবং ৭০,০০০ কোটি টাকা থেকে ১,৪০,০০০ কোটি টাকা রাজনীতিবিদদের করায়ত্ত হয়েছে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এসব আমলা ও রাজনীতিবিদদের স্ত্রীসন্তানরা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে।

১১) দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে কমপক্ষে তিন বিলিয়ন ডলার সরাসরি লুট করা হয়েছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের ‘ক্যাপাসিটি চার্জের’ নামে লুট করা হয়েছে এক লক্ষ দশ হাজার কোটি টাকা। ভারতের আদানির ঝাড়খন্ডের বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট থেকে মাত্রাতিরিক্ত দামে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয়েছে অত্যন্ত গোপনে।

১২) কর অব্যাহতি (ট্যাক্স একজেম্পশান) প্রদানের মাধ্যমে কয়েক বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই কর অব্যাহতিগুলোকে যৌক্তিক পর্যায়ে আনা গেলে শিক্ষা খাতের ব্যয় দ্বিগুণ ও স্বাস্থ্যখাতের ব্যয় তিনগুণ বাড়ানো যেতো।

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধতাসাওউফ, খোদাপ্রেম, সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা এবং বিশ্বঅলি সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)
পরবর্তী নিবন্ধপ্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একিভূত হওয়ার ঘোষণা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের