প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপ্রকল্প থেকে চীনকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ভারতের কূটকৌশল কত গভীর হতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে পতিত স্বৈরশাসক হাসিনার ২০২৪ সালের জুনের ভারত সফরের সময়। ২০২৪ সালের ২২–২৩ জুনে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার দু’দিনের ভারত সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে বাংলাদেশের তিস্তা মহাপরিকল্পনায় ভারতের অংশ গ্রহণের বিষয়টি আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, এবং আগ বাড়িয়ে এ–ব্যাপারে ভারতের একটি ‘টেকনিক্যাল টিমকে’ বাংলাদেশে প্রেরণের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছিলেন। আমার বরাবরই সন্দেহ ছিল যে ভারতের ভেটোকে উপেক্ষা করে হাসিনার বাংলাদেশ সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনের অর্থায়নের প্রস্তাব বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিতে পারবে না। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে শেখ হাসিনার জুন মাসের বৈঠকে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি আলোচনার এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা জানা যায়নি। ঐ বৈঠকে এর পরিবর্তে গঙ্গার ফারাক্কা পানি চুক্তি নবায়নের বিষয় সম্পর্কে বর্তমান চুক্তির মেয়াদের প্রায় দুই বছর বাকি থাকতেই আলোচনা শুরু হওয়ার খবর বেরিয়েছিল ভারতের পক্ষ থেকে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই বিষয়টিকে রহস্যময় আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গকে না জানিয়ে একতরফাভাবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ফারাক্কা চুক্তি নবায়নের সাংবিধানিক অধিকার নেই’। তাই, নতুন করে এ–সম্পর্কীয় চুক্তি নবায়নের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতার কথাও প্রকাশ করেছিলেন তিনি। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, মমতা ব্যানার্জির ভেটোর কারণে ২০১১ সালে ভারত–বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তিস্তার পানি চুক্তি–স্বাক্ষর একেবারে শেষ মুহূর্তে ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল।
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা নদীর পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প প্রণয়নের জন্য শি জিন পিংকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যাতে ‘চীনের দুঃখ’ হিসেবে একদা বিশ্বে বহুল–পরিচিত হোয়াংহো নদী বা ইয়েলো রিভারকে চীন যেভাবে ‘চীনের আশীর্বাদে’ পরিণত করেছে ঐ একই কায়দায় বাংলাদেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনগণের জন্য প্রতিবছর সর্বনাশ ডেকে আনা তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাকেও একটি বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা যায়। হাসিনার অনুরোধে সাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ চীনা অর্থায়নে প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপ্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পর প্রকল্প–প্রস্তাবটি চীনের পক্ষ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানের যে প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ তা গ্রহণ করেছিল বলেও জানা যায়। প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপ্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন চালিয়ে নদীর মাঝখানের গভীরতাকে দশ মিটারে বাড়িয়ে ফেলা হতো এবং নদীর প্রশস্ততাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা হতো। একইসাথে, রিভার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা হতো। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হতো। উপযুক্ত স্থানে বেশ কয়েকটি ব্যারেজ–কাম–রোড নির্মাণ করে নদীর দু’তীরের যোগাযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণের জন্য জলাধার সৃষ্টি করে সেচখাল খননের মাধ্যমে নদীর উভয় তীরের এলাকার চাষযোগ্য জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হতো। উপরন্তু, নদীর উভয় তীরের সড়কের পাশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ন সুবিধাদি গড়ে তোলা হতো। ইন্টারনেটে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বর্ণনা জেনে আমার মনে হয়েছে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সত্যিসত্যিই তিস্তা মহাপ্রকল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্য–পীড়িত উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনজীবনে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হতো।
প্রথম থেকেই এই প্রকল্পে বাগড়া দিচ্ছিল ভারত। ভারতের দাবি, তাদের শিলিগুড়ি করিডরের ‘চিকেন নেকের’ এত কাছাকাছি তিস্তা প্রকল্পে কয়েক’শ বা হাজারের বেশি চীনা নাগরিকের অবস্থানকে ভারত মেনে নেবে না। অতএব, বাংলাদেশকে এই প্রকল্প থেকে সরে আসতে বলা হচ্ছিল। একবার শোনা গিয়েছিল, ভারতের নিরাপত্তা সম্পর্কীয় উদ্বেগকে আমলে নিয়ে সীমান্ত–নিকটবর্তী ১৬ কিলোমিটার নদীর খনন বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে করবে। সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ ছিল, যেহেতু ভারতের ‘শিলিগুড়ি চিকেন নেক্’ এবং ‘সেভেন সিস্টার্সের’ ভূ–রাজনৈতিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার অভিযোগ তুলে চীনের অর্থায়নের ব্যাপারে ভারত প্রকল্পের বিরোধিতা করছে তাই মহাপরিকল্পনার বিভিন্ন ডাইমেনশনকে কাটছাঁট করে শুধু নদীখনন, ভূমি উদ্ধার, নদীপাড়ের দু’পাশের পরিবর্তে আপাততঃ একপাশে মহাসড়ক নির্মাণ, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন সুবিধা গড়ে তোলা পরবর্তী সময়ের জন্য রেখে দিয়ে বর্তমান পর্যায়ে শুধু জলাধার নির্মাণ, ব্যারেজ নির্মাণ,সেচখাল খনন ও সেচ ব্যবস্থা চালু করার বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্পের রি–ডিজাইন করে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন অবিলম্বে শুরু করা হোক্। আমরা যদি প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিশ্ব ব্যাংককে দাঁতভাঙা জবাব দিতে পারি তাহলে রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার মত দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত পাঁচটি জেলার এক কোটির বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ এক বিলিয়ন ডলারেরও কম ব্যয়ের একটি প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে করতে পারব না কেন? রিভাইজ্ড ডিজাইনে প্রকল্পের খরচ এক–তৃতীয়াংশের মত কমে আসতো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভারতের দাদাগিরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সর্বোত্তম উপায় হতো নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। কিন্তু, চীনকে এই প্রকল্প থেকে বের করার উদ্দেশ্যে ভারত তিস্তা প্রকল্পে তাদের অর্থায়ন ও অংশগ্রহণের প্রস্তাব বাংলাদেশ সরকারকে গছানোর জন্য হাত–মোচড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেজন্যই আগ বাড়িয়ে জুন মাসে মোদীর টেকনিক্যাল টিম প্রেরণের প্রস্তাব!
তিস্তা নদী ঐতিহাসিকভাবেই অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং খামখেয়ালি আচরণের একটি নদী, যার বন্যার কবলে পড়ে প্রায় প্রতি বছর বর্ষায় বাংলাদেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চল একাধিকবার বিধ্বস্ত হয়ে চলেছে। আবার, শুষ্ক মৌসুমে তুলনামূলকভাবে খরাগ্রস্ত এই এলাকার মানুষ তিস্তা নদীর পানিস্বল্পতাহেতু সেচসুবিধা থেকেও বঞ্চিত থাকে। তিস্তা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় ভারত একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়ার পর তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশ বছরের বেশির ভাগ সময় প্রায় পানিশূন্য থাকছে। বর্তমান ২০২৪ সালেও তিস্তার পানিস্বল্পতার ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। বলা হয়, এলাকার জনগণের জীবন ও জীবিকার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ তিস্তা নদী। বাংলাদেশ বন্ধুরাষ্ট্র হলেও একটি আন্তর্জাতিক নদীর উজানে এহেন একতরফা বাঁধ নির্মাণ কিংবা খাল খননের আগে ভারত একবারও বাংলাদেশের সাথে আলাপ–আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং, দীর্ঘ তিন দশকের কূটনৈতিক আলোচনার পথ ধরে যখন ২০১১ সালে দু’দেশ তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অন্যায়–আবদারের কাছে নতি স্বীকার করে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং চুক্তি স্বাক্ষর থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। আমার আশংকা, যদ্দিন মমতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন তদ্দিন ন্যায্য শর্তে বাংলাদেশের সাথে ভারতের তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের কোন সম্ভাবনা নেই।
ইতোমধ্যে ঐতিহাসিক গণ–অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হাসিনার সরকার উৎখাত হয়ে গেছে। এর ফলে বর্তমানে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে ভারতের মোদী সরকারের সম্পর্ক তেমন বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না, যেজন্য হয়তো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এজেন্ডায় অদূর ভবিষ্যতে থাকবেই না। অবশ্য, তিস্তা চুক্তি আর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প মোটেও সাংঘর্ষিক নয়। তিস্তা চুক্তি হোক্ বা না হোক্ সংকুচিত ডিজাইনে হলেও তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন ঐ অঞ্চলের জনগণের জীবন ও জীবিকায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। চুক্তি হলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহ খানিকটা হয়তো বাড়বে, কিন্তু বর্ষায় গজলডোবা ব্যারেজের সব গেট খুলে দেওয়ায় এতদঞ্চলের জনগণ যে একাধিকবার বন্যায় ডুবছে তার তো কোন সমাধান হবে না! চীনের প্রস্তাবিত প্রকল্পের জলাধারগুলোর সংরক্ষিত পানি পরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হলে হয়তো এই সমস্যার টেকসই সমাধান মিলত। চীনের প্রকল্প প্রস্তাবটির আশু বাস্তবায়নের জন্য দেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি মানব–বন্ধন ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
হাসিনা সরকারের পতনের পরও আবার এলাকার জনগণ চীনের প্রকল্প–প্রস্তাবটি গ্রহণের জন্য সভা ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। যেহেতু প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী হাত–মোচড়ানোর কাছে নতি স্বীকার করার কথা নয় তাই আমরা কি আশা করতে পারি না যে অনতিবিলম্বে এই সরকার চীনকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্পটি অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের জন্য আমন্ত্রণ জানাবে? নিদেনপক্ষে সংকুচিতভাবে হলেও আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে আমার প্রস্তাবিত প্রকল্পের ডিজাইনটির বাস্তবায়ন অনতিবিলম্বে শুরু করায় কোন বাধা তো দেখছি না। সংশ্লিষ্ট নীতি–প্রণেতারা কী বলেন?
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়