গত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখের গণ–অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন হয়েছে, তিনি প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। তাঁর শাসনামলে বিশ্বের কাছে প্রশংসনীয় একটি বিষয় ছিল বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি’র উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার। কিন্তু, অনেকগুলো প্রতারণামূলক কায়দা–কানুন অনুসরণ করে হাসিনা সরকার এহেন উচ্চ মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দেখানোর ব্যবস্থা করত, যা অর্থনীতির প্রকৃত গতিশীলতা ও সুস্বাস্থ্যের প্রতিফলন ছিল না। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংক ঘোষণা করেছে যে চলমান ২০২৪–২৫ অর্থ–বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গত অর্থ–বছরের ৫.২ শতাংশের চাইতে কমে ৪ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। আগের পূর্বাভাসে তারা ২০২৪–২৫ অর্থ–বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫.৭ শতাংশ হবে বলেছিল। আইএমএফ বলেছে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৪.৫ শতাংশ। অনেকে এই ব্যাপারটাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। ঐতিহাসিক গণ–অভ্যুত্থানের ধ্বংসযজ্ঞ ও গত চারমাসের টালমাটাল পরিবর্তনগুলোর পর জিডিপি প্রবৃদ্ধি একেবারে ঋণাত্মক হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। তাই আমি মনে করি, বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফ এর নতুন এসব পূর্বাভাস অনেকটাই আশাপ্রদ বিধায় সমর্থনযোগ্য। হাসিনার শাসনামলে যেসব কায়দা–কানুন অবলম্বন করে মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখানো হতো সেগুলো বক্ষ্যমাণ কলামে আমি ব্যাখ্যা করছি।
তাত্ত্বিকভাবে জিডিপি হলো: (ভোগব্যয়+বিনিয়োগ ব্যয়+সরকারী ব্যয়+রফতানি আয়–আমদানি ব্যয়)। বিনিয়োগ ব্যয় দেশের সঞ্চিত পুঁজি থেকে হয়েছে নাকি বৈদেশিক ঋণের অর্থে হয়েছে সেটা এক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়, উভয় ক্ষেত্রেই জিডিপি বাড়ার ক্ষেত্রে কোন তারতম্য হয় না। তেমনিভাবে সরকারী ব্যয় সরকারী রাজস্বের অর্থায়নে হয়েছে নাকি দেশীয় অভ্যন্তরীণ ঋণ ও বৈদেশিক ঋণের অর্থায়নে হয়েছে সেটাও জিডিপি’তে সরকারী ব্যয়ের অবদান নির্ধারণে তারতম্য সৃষ্টি করে না। হাসিনার সরকার গত সাড়ে পনেরো বছর ধরে যেনতেনভাবে অজস্র অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ করে বিনিয়োগ ব্যয় ও সরকারী ব্যয় বাড়ানোর নীতি বাস্তবায়ন করে দেশের জিডিপি কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর ব্যবস্থা করায় আমাদের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার প্রতি বছর উচ্চস্তরে দেখানো যাচ্ছিল, যা মোটেও টেকসই প্রবৃদ্ধি ছিল না। বৈদেশিক ঋণ নেয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ ব্যয় গত এক দশক ধরে জিডিপি’র অনুপাত হিসেবে ২৩/২৪ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু বিশেষত সরকারী খাতে অজস্র ঋণ করে ঘি খাওয়ার মত অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থ ব্যয় করায় জিডিপি বেড়ে গেছে। সরকারী রাজস্ব আহরণ এদেশে কমতে কমতে জিডিপি’র শতাংশ হিসেবে ৮ শতাংশে নেমে যাওয়া সত্ত্বেও বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থে প্রতি বছর সরকারী ব্যয় বাড়ানোয় জিডিপি দ্রুত বেড়ে গেছে। ঋণ বাড়িয়ে সরকারী ব্যয় বাড়ালে তা জিডিপি’কে বাড়িয়ে দেয়, সরকারী ঋণ বাড়লে জিডিপি কমে না।
৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দৈনিক বণিক বার্তার হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্য–উপাত্তের দাবি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র দুই লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার আট’শ ত্রিশ কোটি টাকা। এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির অংকের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে পনেরো লক্ষ আটান্নো হাজার দুই’শ ছয় কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতি বছর মাথাপিছু জিডিপি’র উচ্চ–প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যা ছিল ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ ও ভয়ানক প্রতারণা। ২০২৪ সালে প্রত্যেক বাংলাদেশীর ঋণের বোঝা এক লক্ষ টাকারও বেশি। কমপক্ষে আগামী এক দশক ধরে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ডুবে থাকবে এই বিশাল অংকের ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধের দায় মেটানোর কারণে। এটাকে মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই। হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগা–প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগা–প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন–চার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা, যেজন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দেশের এমন একটি প্রকল্পের নাম করা যাবে না যেটার খরচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি নয়। গত সাড়ে পনেরো বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি–লুন্ঠনের মহোৎসব–কাল।
সারা দেশের গ্রাম ও শহরগুলোতে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে গত সাড়ে পনেরো বছরে যে শত শত প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে তার মধ্যে কয়েকটি নিকৃষ্ট প্রকল্পের উদাহরণ দেখুন: পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকা–মাওয়া–যশোর–পায়রা রেলপথ, চট্টগ্রাম–দোহাজারী–কক্সবাজার রেলপথ এবং ঢাকা–গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলোতে প্রকৃত ব্যয়ের তিন–চারগুণ বেশি অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে, আর এসব প্রকল্পের আয় থেকে প্রকল্প–ব্যয়ের অতি সামান্য অংশ মেটানো যাবে। কিন্তু, বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম ‘সাপ্লায়ার’স ক্রেডিট প্রকল্প’ ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি আক্ষরিকভাবেই ‘সাদা হাতি প্রকল্প’। প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১৩৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১২০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে রাশিয়া। অনেকেরই জানা নেই যে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে ভারতের তামিলনাড়ুর কুদান কুলামে ২০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়েছে কয়েক বছর আগে। অথচ, আমাদের ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিতে হচ্ছে কেন? ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য ১৩৫০ কোটি ডলার খরচ একেবারেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার! দুর্নীতির খাই কতখানি সর্বনাশা হলে এরকম একটি প্রকল্প গৃহীত ও বাস্তবায়িত হতে পারে!! ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
মোট জিডিপিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় মাথাপিছু জিডিপি। সাবেক অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল যখন পরিকল্পনা মন্ত্রী ছিলেন তখন থেকেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ‘ডাটা ডক্টরিং’ এর কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর নির্দেশে ঐ সময় থেকে ‘ডাটা ডক্টরিং’ এর সহায়তায় মোট জিডিপিকে বাড়িয়ে দেখানো এবং মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো পরিসংখ্যান ব্যুরোর খাসলতে পরিণত হয়েছিল। পরিকল্পনা মন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৪ সাল থেকে এহেন ‘ম্যানুফেকচারড’ তথ্য–উপাত্তের মাধ্যমে প্রতি বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। গত এক দশক ধরে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে কাহিনী প্রচার করে হাসিনার সরকার দেশে–বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছিল তার সিংহভাগই ছিল ভুয়া ও ভিত্তিহীন। এটা অনেকেরই জানা নেই যে মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড় যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন–মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক অবস্থানের দরিদ্র জনগণের আয়ের বন্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে লুকিয়ে ফেলে। এর মানে, একজন কোটিপতির আয়ের সাথে একজন ফকিরের শূন্য আয়ের গড় করলেও ঐ ফকিরের মাথাপিছু আয় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা হয়ে যাবে। মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বন্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের কয়েক হাজার উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে, যার ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন–মধ্যবিত্ত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো বাংলাদেশের জনগণের আয়বৈষম্য–পরিমাপক জিনি সহগ, যা ১৯৭৩ সালে ছিল ০.৩৬, সেটা বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের খানা আয়–ব্যয় জরিপে পর্বতপ্রমাণ ০.৪৯৯ এ পৌঁছে গিয়েছিল। কোন দেশের জিনি সহগের মান ০.৫ হলে সে দেশকে ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ’ বলা হয়। অতএব, নিঃসন্দেহে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি ‘উচ্চ–আয়বৈষম্যের’ দেশে পরিণত হয়েছে। বিশেষত, অজস্র ঋণ করে এভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর কৌশল পুরো জাতিকে যে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদী ঋণের সাগরে নিমজ্জিত করেছে সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়েছে এজন্য যে ঐ ঋণের সিংহভাগই স্রেফ পুঁজি–লুন্ঠনের মাধ্যমে লুন্ঠিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। হাসিনা আমলের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছিল পুঁজি পাচার। নিউইয়র্ক–ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইনেন্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি দাবি করেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে পনেরো বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে দেশটাকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছে যার সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এই পুঁজি–লুন্ঠনের কেন্দ্রে ছিল হাসিনা–পুত্র জয়, রেহানা–কন্যা টিউলিপ ও রেহানা–পুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী ববি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও তার পুত্র শেখ ফাহিম, শেখ হেলাল, তাঁর ভাই শেখ জুয়েল ও তাঁর পুত্র শেখ তন্ময়, সেরনিয়াবাত হাসনাত আবদুল্লাহ ও তাঁর পুত্র সাদিক আবদুল্লাহ, শেখ তাপস, শেখ পরশ, লিটন চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরী এবং হাসিনার অন্যান্য আত্মীয়–স্বজন। আর ছিল এস আলম, সালমান রহমান, সামিটের আজিজ খান, বসুন্ধরার আকবর সোবহান, অরিওন গ্রুপের মাহমুদুল করিম ও নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের মত লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার লুটেরা রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ আমলা। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের পুত্র সোহেল তাজ অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদেরকে দু’হাতে টাকা বানাতে হবে’। অতি সম্প্রতি হাসিনার উপদেষ্টা সালমান রহমান রিমান্ডে স্বীকার করেছে, এস আলম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে এক লক্ষ কুড়ি হাজার কোটি টাকার বেশি লুট করেছে তার অর্ধেকটাই দিতে হয়েছে জয় ও টিউলিপকে! সালমান রহমান নিজেও তার মালিকানাধীন বেক্সিমকোর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ছত্রিশ হাজার আট’শ পঁয়ষট্টি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে যে দেশের চলমান ৮২টি প্রকল্পে শেখ হাসিনার কোন না কোন আত্মীয়–স্বজন জড়িত রয়েছে, যেগুলোর প্রকল্প–ব্যয় একান্ন হাজার কোটি টাকার বেশি।
আর একটি বিষয় হলো, হাসিনার শাসনামলে কৃত্রিমভাবে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন রফতানি আয়ের প্রকৃত অবস্থাটা দেখাতে শুরু করেছে তখন ২০২৩–২৪ অর্থ–বছরের রফতানি আয় আগের অর্থ–বছরের চাইতে কমে গেছে। উপরন্তু, এখন যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় পুঁজি–লুন্ঠন অনেকখানি কমে গেছে তাই বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ ব্যয় এবং সরকারী ব্যয় চলতি অর্থ–বছর অনেকখানি কমে যাবে। ফলে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও কমে যাবে। একইসাথে, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে আন্দোলন, গণ–অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থান–পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, তৈরী পোশাক শিল্পের উৎপাদন–সংকট, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী–সংসদ সদস্য–নেতা–কর্মী, হাসিনার পরিবার ও আত্মীয়–স্বজনের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর এবং সামগ্রিক উৎপাদন–বিঘ্নকারী কর্মকান্ডের নেতিবাচক প্রভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত প্রভাবে চলতি অর্থ–বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ বা ৪.৫ শতাংশে নেমে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে আশার কথা হলো, প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যাংকিং খাত ও সামগ্রিক অর্থনীতিকে আবার সুষ্ঠু পথে ফিরিয়ে আনার জন্য যথোপযুক্ত নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। প্রফেসর ইউনূসের ব্যক্তিগত ইমেজের কারণে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হতে চলেছে প্রায় দশ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সহায়তা, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে কয়েক বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে দেবে। একইসাথে, প্রবাসী বাংলাদেশীরা যেভাবে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স–প্রেরণের জোয়ার সৃষ্টি করেছেন তা অব্যাহত থাকলে অর্থর্নীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করবেই। সবচেয়ে বড় কথা, বর্তমান সরকার দুর্নীতি–মুক্ত ও দেশপ্রেমিক। তাই, আগামী অর্থ–বছরে দেশ আবার উচ্চ–প্রবৃদ্ধির রাজপথে উঠে যাবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়