বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের নির্বাচনটি হয়েছিল ‘তিন জোটের রূপরেখা’ অনুসারে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে, ঐ সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা যাবে না। ১৯৯৬ সালে কেয়ারটেকার সরকার আইন পাশ হওয়ার পর ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে। কিন্তু, ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত চারটি সংসদ নির্বাচনেই বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমতাসীন দল বা জোটকে প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পতিত স্বৈরাচারী সমর–প্রভু এরশাদের নির্বাচনী বিপর্যয় প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলোতে ভোটের মাধ্যমে জনসমর্থন পেয়ে আগেরবারের নির্বাচিত ক্ষমতাসীন দল বা জোট পরের প্রতিবারই প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যে প্রবল চপেটাঘাতের শামিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি দ্রুত জনপ্রিয়তা হারানোতে নির্বাচনে কারচুপি করতে গিয়ে মাগুরায় ধরা খেয়ে যায়, যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রবল আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করার জন্যে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করতে বাধ্য হয়। তাড়াহুড়ো করে পাশ করা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বিএনপি ইচ্ছাকৃতভাবে বেশ কয়েকটি মারাত্মক ঘাপলা রেখে দেয়। প্রথম চালাকি ধরা পড়ে যায় তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস কর্তৃক রহস্যজনকভাবে সেনা বাহিনীর চীফ অব স্টাফ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অগোচরে (অথচ বেগম জিয়ার নির্দেশে) সেনাবাহিনীর কয়েকজন সিনিয়র কমান্ডারকে বরখাস্ত করার ঘটনায়। ঐ আদেশের প্রতিক্রিয়ায় সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দেয়। তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও কয়েকজন উপদেষ্টার প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার কারণে সরকার ঐ সেনাবিদ্রোহ দমাতে সমর্থ হলেও চীফ অব স্টাফ সহ ঐ সময়ের বেশ কয়েকজন মেধাবী সেনা কমান্ডার ও অফিসার বিদ্রোহের কারণে চাকুরিচ্যুত হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছিল বলে দেশে–বিদেশে বহুল–প্রশংসিত হলেও পরাজয় মেনে নিতে পারেনি বিএনপি; তারা ১৯৯১ সালের শেখ হাসিনা স্টাইলে কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করে। এরপর আবারো রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ব্যবহার করে বেগম জিয়া বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, যে ষড়যন্ত্রটি এদেশে নিযুক্ত কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের সহায়তায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন।
২০০১ সালের নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগেই রাষ্ট্রপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টাবৃন্দ, সামরিক বাহিনী, সিভিল আমলাতন্ত্রের ডিসি, এডিসি, ম্যাজিস্ট্রেট, ডিআইজি, এসপি, ডিএসপি, এএসপি, ওসি—সবার নির্বাচনকালীন ভূমিকাকে ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং–এ ব্যবহারের ফন্দি–ফিকিরগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর আয়ত্তে চলে আসে। এমনকি, বিএনপি, জামায়াত ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে পুরো সিভিল প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে নিজ নিজ দলের সমর্থকদের সক্রিয় নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে মরিয়া প্রয়াস চালায়। বিজয়ী দল বা জোট ক্ষমতাসীন হয়ে পাঁচ বছরের জন্যে ক্ষমতার বেলাগাম অপব্যবহারের লাইসেন্স পাওয়ার ‘কালচার’ গড়ে ওঠা, এবং রাষ্ট্রীয় সকল চাকুরি, আকর্ষণীয় পদ, ঠিকাদারি, পদোন্নতি ও ব্যাংকঋণ নিজ নিজ দলের ধান্দাবাজ ও তদবিরবাজ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগ–বাঁটোয়ারার রেওয়াজ চালু করা নিঃসন্দেহে দুর্নীতি ও নগ্ন দলবাজি, যা গণতন্ত্রের নামে নিকৃষ্ট ধরনের স্বৈরাচার চালু করেছে এদেশে। দেশের সংবিধান যদিও ঘোষণা করছে ‘জনগণই এই রাষ্ট্রের মালিক’ তবুও প্রকৃত বিচারে ক্ষমতার মেয়াদের পুরো পাঁচ বছর নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদেরকে জনগণের কাছে জবাবদিহির তোয়াক্কাই করতে হচ্ছে না। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীকে আরো সর্বনাশা একক ক্ষমতার অধিকারী করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে সংবিধানের ৭০ ধারার ইচ্ছেমত প্রয়োগের ক্ষমতা এই দু’জনের হাতে অর্পণের মাধ্যমে। তাঁদের একক সিদ্ধান্তে এই দু’দলের যে কারোর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে, এবং গত ৩২ বছরে দু’দলেই এরকম লাগামহীন ক্ষমতা প্রয়োগের একাধিক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন দু’নেত্রীই। (বিএনপি’র মান্নান ভুঁইয়া এর শিকার হয়েছেন)। ফলে, একদা বাঘা বাঘা নেতারা দু’দলেই নেত্রীদের একান্ত অনুগত অবস্থানে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন ৭০ ধারার ভয়ে। এদ্দিনে পরিষ্কার হয়ে গেছে, ১৯৯১–২০০৬ পর্যায়ে দুর্নীতি, লুটপাট, দলবাজি, টেন্ডারবাজি, আত্মীয়–তোষণ, চাঁদাবাজি, মাস্তানি— এসবের তান্ডব ক্ষমতাসীন দল বা জোটের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ও ক্রোধকে পুঞ্জীভূত করছিল নির্বাচনী মেয়াদের পুরো পাঁচ বছর জুড়েই। ফলে, ক্রমেই বিজয়ী দল বা জোটের জনপ্রিয়তায় ধস নামাই নিয়মে পরিণত হয়েছিল, সুযোগ পেলেই ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদেরকে শিক্ষা দিতে চেয়েছে ভোটাররা। মেয়াদের অর্ধেক বাকি থাকতেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ও বিভিন্ন উপনির্বাচনে ধরাশায়ী হয়ে যাচ্ছিল ক্ষমতাসীন দল বা জোটের প্রার্থীরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় এই নির্বাচনী মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলায় নেতিবাচক ভোটের ফায়দাভোগী হয়ে যাচ্ছিল একবার আওয়ামী লীগ আরেকবার বিএনপি।
ইতোমধ্যেই বলেছি, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রপতিকে ব্যবহার করে ‘ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং’ করতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দৃঢ়তা ও প্রজ্ঞার কারণে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছিল বারংবার। ২০০১ সালের নির্বাচনে খোদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সিভিল প্রশাসন এবং মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা–সিপাহীরাই প্রধান দু’দলের ‘ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং’ এর হাতিয়ার হয়ে গিয়েছিল। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে হজ্বব্রত পালন করতে গিয়ে পবিত্র মদীনা নগরীতে অবস্থান করার সময়েই তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেভাগেই মার্চ মাসে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু, দেশে ফেরার পর তিনি পিছিয়ে গেলেন। পত্র–পত্রিকায় কারণ উদঘাটন হলো যে স্বাধীনচেতা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের চাইতে তুলনামূলক নিরীহ বিচারপতি লতিফুর রহমানকে আওয়ামী লীগ অধিকতর নিরাপদ বিকল্প মনে করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ায় বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তিনিই প্রধান উপদেষ্টা হতে যাচ্ছেন তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাসখানেক আগেই তিনি তাঁর কথিত ‘হোমওয়ার্ক’ শুরু করে দিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা কাকে কাকে করবেন। এখন জানাজানি হয়ে গেছে যে এরকম কয়েকজন উপদেষ্টাও তাঁর হোমওয়ার্কে অংশগ্রহণ করেছেন আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব লাভের আগেই। একইসাথে, বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কয়েকজন আমলাও গোপনে তাঁদের নিজস্ব হোমওয়ার্ক শুরু করে দিয়েছিলেন সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর মাঠ–পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যে ছক আওয়ামী লীগ সাজিয়ে রেখেছিল তা কিভাবে বিএনপি–জামায়াতপন্থী কর্মকর্তাদেরকে রদবদল ও গণ–ট্রান্সফারের মাধ্যমে তছনছ করে দেওয়া যায়। ঐ সময়ের মুঈদ–মঈনুল–শাহজাহান কমিটিকে ব্যবহার করে ঐ বিএনপি–জামায়াতপন্থী কুশীলবরা কিভাবে দু’মাসেরও কম সময়ে ১৫২৬ জন কর্মকর্তার ট্রান্সফার সুসম্পন্ন করেছিল ঐ কাহিনী পরবর্তীকালে ঐ কুশীলবদের কয়েকজনের পত্র–পত্রিকায় প্রদত্ত জবানীতেই খোলাসা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, এর ফলে যে আওয়ামী লীগপন্থী কর্মকর্তাদেরকে নির্বাচনের মাঠ থেকে হটিয়ে দিয়ে তাঁদের স্থলে বিএনপি–জামায়াতপন্থী কর্মকর্তাদেরকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাতে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বলা যাবে কি? এরপর বিএনপি দফায় দফায় দাবি তুলল, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনের অন্তত এক সপ্তাহ আগে সেনা বাহিনী মোতায়েন করতে হবে সারা দেশে—নয়তো আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের মাস্তানরা নাকি ভোটকেন্দ্র দখল করে রাখবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের এতৎসম্পর্কীয় সুপারিশ মেনে নিলেন প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন। সেনা বাহিনী মাঠে গিয়ে ধাওয়া দিল মাস্তান–পাতি মাস্তান–ক্যাডারদেরকে, পালিয়ে বাঁচল বীর পুঙ্গবরা। কিন্তু, আওয়ামী ‘দুষ্টলোকদের’ খালি করা মাঠ যে বিএনপি–জামায়াতের ক্যাডার ও মাস্তানরা দখল করে নিয়েছিল ঐ সত্যটাও এদ্দিনে খোলাসা হয়ে গেছে। অতএব, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী বিপর্যয়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল যে ক্ষমতাসীন দলের সাজানো বাগান এবং ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং–এর কায়দা–কানুন ভন্ডুল হয়ে যাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কান্ড–কারখানার মাধ্যমে; চরিত্রগতভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন দল–বিরোধী (ধহঃর–রহপঁসনবহঃ)।
২০০১–২০০৬ মেয়াদে বিএনপি–জামায়াত জোট আর ঝুঁকি নিতে চায়নি। তারা তাদের শাসনামলের প্রথম থেকেই সেনা বাহিনী, সিভিল প্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনী থেকে রিঃপয–যঁহঃ এর মাধ্যমে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিল আওয়ামীপন্থী ও মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদেরকে। সাতজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জেনারেল মইন ইউ আহমদকে সেনা বাহিনীর চীফ অব স্টাফ করা হলো। বঙ্গবন্ধুর মাজার জেয়ারত করার অপরাধে অপমানজনকভাবে ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে রাষ্ট্রপতি করা হলো প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে। বিএনপি’র প্রাথমিক পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্পাদক বিচারপতি কে এম হাসানকে পুরস্কার হিসেবে হাইকোর্টে বিচারপতি করা হয়েছিল; আর তাঁকেই ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার অংক কষে বিএনপি’র ‘চাণক্য–প্রবররা’ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স দু’বছর বাড়িয়ে ৬৭ বছরে নির্ধারণ করে দিল। ধুরন্ধরদের এই ‘অতি চালাকি’ জনগণের কাছে ধরা পড়ে গেল, শুরু হয়ে গেল হাসান–বিরোধী প্রাণঘাতী আন্দোলন–সংগ্রাম। আন্দোলনের তীব্রতা উপলব্ধি করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দুপুরেই বিচারপতি হাসান রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টা হবার ব্যাপারে তাঁর অসম্মতি জানিয়ে দিলেন। কিন্তু, ঐ মহাগুরুত্বপূর্ণ খবরটা জাতিকে না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন মোবাইল টেলিফোনে তা জানালেন শুধু বেগম জিয়াকে। বেগম জিয়া তখন নয়াপল্টনের সভামঞ্চে। টিভি ক্যামেরায় আমরাও দেখলাম, তিনি কলটি রিসিভ করে ঐ সভার বক্তৃতা না দিয়েই তড়িঘড়ি মঞ্চ থেকে নেমে গাড়ীবহর নিয়ে সোজা চলে গেলেন বঙ্গভবনে। টিভি সাংবাদিকরা তাঁর ঐ রহস্যজনক ‘বঙ্গভবন–গমন’ অনেকখানি কভার করাতে আমরা দর্শকরাও জানলাম ব্যাপারটা। ঐদিন রাত সাড়ে এগারটায় বঙ্গভবন থেকে জাতিকে জানানো হয়েছিল যে স্বাস্থ্যগত কারণে বিচারপতি হাসান প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ব্যাপারে অপারগতা জানিয়েছেন। পাঠকদের অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন, ২৮ অক্টোবরের ঐ বিকাল থেকে শুরু করে রাত বারটার মধ্যেই নারকীয় দাঙ্গাহাঙ্গামায় এদেশের ১২ জন মানুষ নিহত হয়েছিলেন সারা দেশে—এসব মানুষের মৃত্যুর জন্যে বেগম জিয়া এবং রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন কি তাঁদের নৈতিক দায় এড়াতে পারবেন? এরপর, তাঁদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেকই সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিধান অনুসারে বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার অনুরোধ না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে গেলেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখে বেগম জিয়ার নির্দেশমত সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ পদে মেজর জেনারেল রাজ্জাকুল হায়দারকে নিয়োগ দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াজুদ্দিন, কিন্তু ঐ খবর আগেভাগে ফাঁস হওয়াতে জেনারেল মইন ইউ আহমদ সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এর ফলেই ১/১১ তে বাংলাদেশ আবারো ছদ্মবেশী সেনা–শাসনের কবলে পড়েছিল। সেনাবাহিনী সরাসরি শাসন করার খায়েসে ব্যর্থ হওয়ায় ২০০৮ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল।
কলামের মূল বক্তব্যটা বলার প্রয়োজনেই ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৬–৭ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এদেশের মূল দুটো রাজনৈতিক দলের চাতুর্যপূর্ণ চাল–পাল্টাচালের কাহিনীটা বর্ণনা করতে হলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বারবার ‘ম্যানিপুলেশনের’ শিকার হয়েছে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৬–৭ সালে। সর্বোপরি ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করলো অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক, কিন্তু প্রয়োজন মনে করলে আরো দুটো নির্বাচন ঐ ব্যবস্থায় হতে পারে। কিন্তু, সুযোগ বুঝে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বাতিল করে দিলেন শেখ হাসিনা। আর, তখন থেকেই দেশের বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্বহালকে তাদের আন্দোলন–সংগ্রামের মূল দাবিতে পরিণত করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ২০২৩ সালে এখন বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো যতই জোরালো আন্দোলন করুক্ না কেন ভবিষ্যতে গণঅভ্যুত্থানে বাধ্য না হলে আর কোন ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করবে না। জেনেশুনে পরবর্তী নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় কি কোন সরকার চাইতে পারে?
২৪ অক্টোবর ২০২৩
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়