ড. ইউনূস, দৈনিক আজাদী ও একটি শিরোনাম

মন্তব্য প্রতিবেদন

হাসান আকবর | শুক্রবার , ৯ আগস্ট, ২০২৪ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং গতকাল থেকে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই দিন দৈনিক আজাদীর ব্যানার হেড শিরোনাম ছিল ‘আঁরার ইউনূস নোবেল পাইয়্যে’। দৈনিক আজাদী সম্পাদক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক এম এ মালেকের দেয়া ওই শিরোনামটি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এতো বেশি পছন্দ করেছিলেন যে, দৈনিক প্রথম আলো যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে যায়, তখন তিনি শর্ত জুড়ে দেন যে, যদি দৈনিক আজাদী হাতে নিয়ে দেয়া পোজের ছবি সাক্ষাৎকারের সাথে ছাপানো হয় তাহলেই কেবল তিনি সাক্ষাৎকার দেবেন। দৈনিক প্রথম আলো প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওই শর্ত মেনে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলো এবং পরদিন দৈনিক আজাদীর ওই সংখ্যাটি প্রদর্শন করে দেয়া পোজের ছবিই সাক্ষাৎকারের সাথে ছাপানো হয়। দেশে প্রতিযোগী একটি সংবাদপত্রের এই ধরনের ছবি ছাপানোর নজির মনে হয় আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রফেসর ইউনূস ভালোবাসেন চট্টগ্রামকে, ভালোবাসেন তাঁর এক সময়কার লেখালেখির কাগজ দৈনিক আজাদীকে। দৈনিক আজাদীর সেদিনের ‘আঁরার ইউনূস’, আজো ‘আঁরার ইউনূস’ হিসেবেই বিশ্ব জয় করে চলেছেন। সেই আঁরার ইউনূস এবার দেশের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন, হয়েছেন সরকার প্রধান। চট্টগ্রামের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেছেন। আজ যদি শিরোনামটা ‘আঁরার ইউনূস সরকারর প্রধান অইয়্যে’ দিতে পারতাম তাহলে ভালো লাগতো। কিন্তু তিনি এখন দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। ভয়ংকর এক অস্থিতিশীল সময়ে তিনি দেশের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি আবারো আমাদের চট্টগ্রামকে সম্মানিত করলেন।

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর মা বাবার কবর জেয়ারতসহ স্বজনদের সাথে দেখা করতে তিনি ছুটে এসেছিলেন চট্টগ্রামে। ওই সময় তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকারটি নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। এরপর বহুদিন বহুভাবে খুব কাছ থেকে ‘স্যার’কে দেখার সুযোগ হয়েছে। মানুষকে কী পরিমাণ ভালোবাসা যে এই মানুষটি দিতে পারেন, অভাবী মানুষের জন্য কী পরিমাণ মমতায় যে তিনি ভালোবাসা বিলুতে পারেন তা তার কাছ থেকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য এবং মেধার পুরোটাই যে মানুষের তরে উৎসর্গতাও কাছে না গেলে বুঝা যাবে না। পৃথিবীটাকে কি করে আরো সুন্দর বাসযোগ্য করা যায় সেই চিন্তাভাবনাই সারাক্ষণ তাঁর মাথায় ঘুরতে থাকে।

দেশের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র নোবেলজয়ী। শুধু নোবেলই নয়, আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল এ্যাওয়ার্ড এবং মার্কিন কংগ্রেশনাল এ্যাওয়ার্ডসহ শত শত পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে। বিশ্ব ইতিহাসে একইসাথে এই তিনটি পুরস্কার পেয়েছেন এমন মাত্র ১২ জন মানুষের মধ্যে একজন! বর্তমান বিশ্বের জীবিত লিডিং ইন্টালেকচুয়ালদের মধ্যে প্রফেসর ড. ইউনূসের নাম উচ্চারিত হয় প্রথমদিকে, শ্রদ্ধার সাথে।

প্রফেসর ইউনূসের ব্রেইন চাইল্ড ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক ব্যবসা, এবং থ্রি জিরো। ক্ষুদ্র ঋণের কার্যক্রম তিনি শুরু করেছিলেন এই চট্টগ্রামেই। হাটহাজারীর জোবরা গ্রামে। ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজ পৃথিবীর বহুদেশই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য গ্রহণ করেছে। তিনি সামাজিক ব্যবসা নামের অলাভজনক একটি মতবাদও প্রতিষ্ঠা করেছেন। যা আজ ইউরোপ আমেরিকাসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো গ্রহণ করেছে। থ্রি জিরোর একটি তত্ত্বও তিনি প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করছেন। এই থ্রি জিরো হচ্ছে দারিদ্র, বেকারত্ব এবং কার্বন নিঃসরণকে শূন্যে নামিয়ে আনা।

. ইউনূস যে কী পরিমাণ সম্মানিত এবং বিনয়ী একজন মানুষ তা বুঝতে হলে তাঁর সাথে ভ্রমণের সুযোগ নিতে হবে। বিশ্বের বহু উন্নত দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকার প্রধান দর্শক সারিতে বসে তাঁর বক্তৃতা শুনেন। তার দেয়া তত্ত্বগুলো অনুধাবনের চেষ্টা করেন।

মাটির মানুষ’ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীর দেশে দেশে ভিআইপি হলেও আদতে তিনি চট্টগ্রামের মানুষ এবং এখানকার আঞ্চলিক ভাষাই লালন করেন তাঁর অন্তরে। তিনি প্যারিস কিংবা লস এঞ্জেলসের পাঁচতারকা হোটেলের বর্ণিল হলে বসে অবলীলায় চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলেন।

পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষরা তাঁর সাথে ছবি তুলতে লাইন ধরে অপেক্ষা করেন। স্পেনের রাণীকে তাঁর সাথে ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছিলাম প্যারিসের একটি অনুষ্ঠানে। বর্তমান বিশ্বের সেরাদের সেরা স্টার হচ্ছেন মেসি। একটি খবরে পড়েছিলাম যে, সেই মেসি লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে ছবি তোলার জন্য।

গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ খ্যাত বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং সর্বোচ্চ সম্মানজনক প্রতিযোগিতার নাম হচ্ছে অলিম্পিক গেমস। পৃথিবীর উন্নত এবং ধনী দেশগুলো এই অলিম্পিকের জন্য হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করে। তারা নিজেদের মধ্যে এই আসরের হোস্ট হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করে। অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হলেন অলিম্পিক মশাল বাহক। ২০১৬ ব্রাজিলের রিও অলিম্পিকের মশাল বাহক ছিলেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকেও তার অবস্থান ছিলো সম্মানের অন্যতম স্তরে। আর এ বছর প্যারিস অলিম্পিকের মূল থিম করা হয়েছে প্রফেসর ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। অলিম্পিক গেমসের ওয়েবসাইটের টাইটেল পেজে উজ্জ্বলভাবে রয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ছবি!

শুধু অলিম্পিকই নয়, দুনিয়ার বহু বড় বড় আসরেই এই মানুষটি যখন কথা বলেন তখন নিরব দর্শকের ভূমিকায় বসে থাকেন সকলে। মোটা অংকের অর্থ খরচ করে টিকেট কেটে শুনেন তাঁর বক্তব্য। পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চর্চা হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তত্ত্ব। দুনিয়ার বহু উন্নত দেশের সরকার প্রধান দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে ড. ইউনূসের সাথে কথা বলেন, আলোচনা করেন, পরামর্শ নেন। ‘আঁরার সেই ইউনূস’ এবার নিজের প্রিয় জন্মভূমির সতের কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কিভাবে কাজ করেন তা হয়তো সময়ই বলে দেবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাহাড়তলী থানা থেকে লুট ৫ অস্ত্র সেনাবাহিনীর নিকট হন্তান্তর
পরবর্তী নিবন্ধউপদেষ্টা পরিষদে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ জন