ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান তিনি। সরকার ছিলো না, ছাত্র নিয়ন্ত্রকদের চাপে এবং সেনা প্রধানের অনুরোধে রাষ্ট্রপতি তাঁকে ট্রানজিশনাল পিরিয়ডের জন্য দেশ চালানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি নির্বাচিত সরকার প্রধান না হলেও জাতীয় সম্মতির সরকার। নির্বাচনের মাধ্যমে আর একটা সরকার গঠন হলে তাঁর ছুটি। এ হলো কেতাবি কথা। বাস্তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির বেনিফিসিয়ারি তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর বিরোধ মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছিলো। অনেকগুলো মামলায় তাঁকে জড়িয়ে ফেলা হয় এবং দৃশ্যত একের পর এক মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে তিনি হয়রান পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন। তিনি সদা হাসি মুখে জনসমক্ষে তাঁর উপস্থিতি প্রকাশ করলেও হাসিমুখের আড়ালে কষ্ট লুকায়িত ছিলো। এই বিরোধের পেছনে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে তাঁর বাধা দানের কথা প্রকাশ্যে আসলেও গভীরে অন্য কিছুও থাকা অস্বাভাবিক নয়।
ড. ইউনূসের নিজের লেখা এবং তাঁকে নিয়ে যত বই লেখা হয়েছে, আমার মনে হয় তার প্রায় সবই আমি পড়তে সক্ষম হয়েছি এবং পড়ে আমি ইউনূসকে যতটা বুঝেছি তাতে এ কথাটা বলতে ইচ্ছা করছে যে, ইউনূস বিএনপির রাজনৈতিক দর্শন বা আদর্শ সাবস্ক্রাইব করেন না। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার বাথুয়া নামক গ্রামের যে পরিবারে ইউনূস জন্মগ্রহণ করেন, সে পরিবারটির অন্তত রক্ষণশীল পরিবার বলে দুর্র্নাম ছিলো না। তাঁর পিতামহ নজু মিয়া সওদাগর ছিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী; পিতা দুলা মিয়া সওদাগরের সময়ে পারিবারিক স্বর্ণ ব্যবসার আরো প্রসার ঘটে। বাথুয়া গ্রামের একটি বিপ্লবী ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। গত শতাব্দির ১৯০৫–এ লর্ড কার্জন যখন বাঙালির বুকে ছুরি বসিয়ে বাংলাকে দু’ভাগ করে দেন, তখন বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত স্বদেশী আন্দোলনকালে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিপ্লবীরা বাথুয়ার একটি মহাজন বাড়িতে ডাকাতি করেন। সেই ডাকাতির ঘটনার যে মামলা হয়, তাতে অনুশীলন সমিতির সদস্য বিপ্লবী নগেন দে ও অরবিন্দ দে–কে আসামী করা হয়েছিলো। নগেন দে–র দ্বীপান্তর হয়েছিলো আন্দামান সেলুমার জেলে। ড. ইউনূস বিপ্লবের ঐতিহ্যমণ্ডিত বাথুয়ার ভূমিপুত্র। তাঁর পিতামহের নামে সেখানে একটি বাজার আছে, নাম ‘নজু মিয়া হাট’।
ড. ইউনূস একটি মডারেট উদারনৈতিক আবহাওয়ায় লালিত পালিত হয়েছেন। তাঁরা তিন ভাই–ই উত্তরকালে কৃতী হন। মেজ ভাই ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম, এদেশের একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞানের ওপর তাঁর অনেক বই আছে। বিজ্ঞানকে মানুষের বোধগম্য ভাষায় ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করতেন। সেজ ভাই মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর একজন ভালো সাংবাদিক, খ্যাতিমান টিভি উপস্থাপক এবং দক্ষ সংগঠক ছিলেন। তাঁদের সবার ছোট ভাইটি সবার আগে ইহজগত ত্যাগ করেছেন। ড. ইউনূস চট্টগ্রাম শহরে বসবাস ও অধ্যয়নকালে পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসবে মেতে থাকতেন। চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ভাষা সংগ্রামী জওশন আরা রহমানের সহযোগে দু’পাতা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। ড. ইউনূস ও তাঁর ভাই ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম স্কাউট ছিলেন। স্কাটউ হিসেবে ড. ইউনূস ছাত্র জীবনেই পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করে ফেলেন। স্কুল কলেজে যিনি ছিলেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উৎসাহী সংগঠক, যদি ধরে নিই যে, তিনি বদলে গেছেন, তবুও বলবো ‘বারোটুপি’ না হলে এক জীবনে কত আর বদলাতে পারে মানুষ। বারোটুপি শব্দটা দিয়ে মানুষের সুবিধাবাদিতা অর্থাৎ সময় ও সুযোগ বুঝে বোল ও ভোল পাল্টানো স্বভাবের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। আমি যে উদাহরণগুলো পেশ করলাম, তা’ থেকে এটা পরিষ্কার বুঝা যায় যে আধুনিক মন ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক চেতনায় ইউনূস মানস গঠিত হয়েছিলো।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়াকে যদি ধরি যে তিনি বাংলাদেশ জয় করেছেন, আমি বলবো তিনি আগে বিশ্বজয় করেছেন। বাংলাদেশ জয় করে তিনি বেশি কিছু অর্জন করেছেন বলে আমার মনে হয় না। কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টারের চেয়েও একজন নোবেল লরিয়টের দাম বেশি।
অমর্ত্য সেনরা কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টার হতে চেয়ে নিজেদের খাটো করেন না। এমনকি চমস্কি বা এই সেদিন শতবর্ষে প্রয়াত হেনরি কিসিঞ্জারও আমেরিকার যে কোন প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি দামি মানুষ ছিলেন। তাঁকে বলা হতো আমেরিকার থিঙ্কট্যাঙ্ক। ড. ইউনূস বাংলাদেশের থিঙ্কট্যাঙ্ক হয়ে থাকতে পারতেন।
দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ক্ষমতা ড. ইউনূসের হাতে তুলে দিয়েছে। এমনভাবে তাঁর কাছে ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তাব এসেছিলো তাকে পায়ে ঠেলে ফেলে দেয়ারও উপায় ছিলো না। দেশকে বিরাট বিপর্যয় থেকে তিনি রক্ষা করেছেন। প্রাথমিক ধকল সামাল কাটিয়ে ওঠা গেছে। এখন পরিস্থিতি স্থিতিশীল। হয়তো নির্বাচন পর্যন্ত তাঁকে থাকতেই হবে। কিন্তু সময়টা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, বেশ জটিল, পথটা বন্ধুর।
শেখ হাসিনা একতরফা দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে এমন বহু শত্রু তিনি তৈরি করেছেন যে, এখন ড. ইউনূসের কাঁধে বন্দুক রেখে সবাই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে শিকার করতে চাইবে। অতি উৎসাহের বশে অনেকে ইতিমধ্যে বলে ফেলেছেন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক। সেজন্য আদালতে মামলাও হয়েছে।
হাসিনার একগুঁয়ে শাসনে বিদ্বিষ্ট নানা শক্তি, ব্যক্তি ও দল যখন ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিতে সমর্থ হলো, তখন শূন্য ক্ষমতায় বসানোর জন্য ড. ইউনূসই তাদের কাছে বেস্ট চয়েস হিসেবে প্রতিভাত হয়।
শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটা দামি কথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন আমরা প্রতিহিংসা চাই না, আমরা কারো বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেব না–এই হচ্ছে কথা, স্পোর্টসম্যান স্পিরিট। বাংলাদেশে কি শুধু একবার একদল ক্ষমতায় যাবে এবং ক্ষমতাচ্যুত দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা করতে থাকবে। আবার ক’বছর পর সেই দল যখন ক্ষমতায় আসবে, তখন তারা আবার তাদের ওপর হামলা, মামলার প্রতিশোধ নেবে। এই প্রতিশোধ এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি যদি চলতে থাকে, তাহলে দেশের উন্নতি কখন হবে। দেশ কখন এগিয়ে যাবে। দেশের ভালো মন্দ নিয়ে আমরা কখন মাথা ঘামাব।
সোনার মানুষ ড. ইউনূস। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন সেটি সোনা হয়ে গেছে। গরীব মানুষদের ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলতে চেয়েছিলেন, তিনি সফল হয়েছেন, সারা পৃথিবী তাঁর থিওরি গ্রহণ করেছে। তাঁর কনসেপ্ট মেনে তাদের দেশকে উন্নতির সোপানে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি গ্রামীণ ফোন করেছেন, সেই ফোন দেশের শ্রেষ্ঠ মোবাইল অপারেটর রূপে পরিগণিত হয়েছে।
ড. ইউনূস দেশের হাল ধরেছেন, এটা দেশের পরম সৌভাগ্য। অবাঞ্ছিত, অযৌক্তিক, অহেতুক দাবি ও আবদার ধরে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলার চেষ্টা করা হলে, তিনি হয়তো আত্মরক্ষা করতে চাইবেন।
প্যারিস থেকে প্রথম দেশে এসে ড. ইউনূস যে কথা বলেছিলেন, সেটা এখানে উদ্ধৃত করি-“আমাকে চাইলে আমার কথা শুনতে হবে। আমার কথা যদি না শুনেন, তাহলে আমি চলে যাই, আমি যে কাজে ছিলাম, আমার কাজ আমাকে করতে দেন।” এই না হলে ড. ইউনূস। এ কারণেই ড. ইউনূসকে বারবার টুপি খোলা অভিবাদন জানাতে চাই।
শেষ কথা : ড. ইউনূস আমাদের চট্টগ্রামের গর্ব, বাংলাদেশের গৌরব। চট্টগ্রাম থেকে কখনো কেউ দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টার হননি, ড. ইউনূসই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টা হলেন। আমরা কায়মনোবাক্যে ড. ইউনূসের চূড়ান্ত সাফল্য কামনা করি।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক।