শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ১০ থেকে ১৫ জনের নাম প্রস্তাব করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন; যা আরও আলোচনার পর চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে সর্বজন গ্রহণযোগ্য, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। এবং আজকে মহামান্য রাষ্ট্রপতিও সম্মতি দিয়েছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত সময়ের মধ্যে গঠন করা হবে। খবর বিডিনিউজের।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠনের জন্য ১০–১৫ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা দেওয়ার কথা তুলে ধরে নাহিদ বলেন, এবং আমরা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি প্রাথমিক তালিকা দিয়ে এসেছি। যেখানে নাগরিক সমাজসহ ছাত্র প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এবং খুবই দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা এই তালিকাটি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এটি চূড়ান্ত করা হবে। খুবই দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা করা হবে।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকে ইউনূসকে প্রধান করার এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকের পর বঙ্গভবনের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়ে বলা হয়, বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাদের প্রস্তাবের সাথে একমত পোষণ করেন। সন্ধ্যায় ৭টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বৈঠক হয় বঙ্গভবনে। বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকও উপস্থিত ছিলেন। এদিন দুপুরে সংসদ বিলুপ্তির পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠন নিয়ে আলোচনা করতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানের ডাকে বঙ্গভবনে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ সমন্বয়ক। তাদের সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান।
বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে এক ব্রিফিংয়ে বৈঠকে আলোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও অধ্যাপক আসিফ নজরুল। নাহিদ বলেন, আমাদের দীর্ঘ সময় বর্তমান পরিস্থিতি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের একটি ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। এবং ছাত্র–নাগরিক অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ থেকে যে সরকার প্রস্তাব করা হবে, সেই প্রস্তাবিত সরকাই চূড়ান্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে, সেই নিশ্চয়তা আমরা আজকে বঙ্গভবন থেকে পেয়েছি।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি দেশের যে অরাজকতা, সহিংসতা চলেছে বিভিন্ন ধরনের, তার প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এবং আমরা সকলের প্রতি আহ্বান জানাব যে, ছাত্র–নাগরিকদের প্রস্তাবিত সরকারই বাংলাদেশে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘোষণা করা হবে। জনগণ যাতে সেই আস্থাটি রাখেন এবং আমাদেরকে অবশ্যই সরকারি স্থাপনা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে, তাদেরকে রক্ষা করতে হবে। এবং পুলিশ বাহিনীকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে দ্রুতই জনগণের মধ্যে শান্তি–শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য নিয়োগ করা হবে।
ছাত্র–নাগরিকদের ঢাকায় ট্রাফিকের দায়িত্ব নেওয়া এবং মন্দির পাহারার উদ্যোগ রাষ্ট্রপতিসহ অন্যদের ‘প্রশংসা’ কুড়ানোর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফিরে না আসা পর্যন্ত আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে এবং আমাদেরকে কোনো ধরনের নাশকতা যাতে না হয়, লুটপাট যাতে না হয়, সেজন্য ছাত্র–জনতাকে পাহারা দিতে হবে, সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। সকলে মিলে ছাত্র–জনতার দেশ গঠনের মাধ্যমে আমরা যে নতুন বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণ করব।
তালিকার বিষয়ে এক প্রশ্নে নাহিদ বলেন, ১০–১৫ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা আমরা দিয়েছি। সেটা এখন আমরা প্রকাশ করব না, যেহেতু এটা প্রাথমিক, সেটা আমরা চূড়ান্ত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে জানাব।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই চূড়ান্ত তালিকাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণাটি দেশবাসী পাবেন বলে আশ্বস্ত করেন তিনি। ড. ইউনূস কবে ফিরবেন? এমন প্রশ্নে নাহিদ বলেন, উনার একটি মাইনর অপারেশন আজকে হয়েছে, উনি আগামীকালই দেশের উদ্দেশে রওনা হবেন। হয়ত আগামীকাল (বুধবার) রাতে অথবা পরশু দিন (বৃহস্পতিবার) সকালের মধ্যে উনি দেশে এসে পৌঁছাবেন এবং এরই মধ্যে আমাদের তালিকাটিও চূড়ান্ত হয়ে যাবে। হয়ত আমরা ২৪ ঘণ্টা বা আরও কিছু সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ সেটি আমরা করে ফেলতে পারব।
কোন বিধানে সরকার গঠন ও নির্বাচন হবে, সেই প্রশ্নে আসিফ নজরুল বলেন, আমরা একটা এঙট্রাঅর্ডিনারি সিচুয়েশনের মধ্যে এই সরকার গঠন করতে যাচ্ছি। এঙট্রাঅর্ডিনারি সিচুয়েশনে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে এটাকে বৈধতা দেওয়ার সাংবিধানিক রীতি আছে, নিয়ম আছে। সেটা অনুসরণ করা হবে। সরকারের মেয়াদ এখনও ঠিক করা হয়নি।
কতদিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের এই তালিকা যেহেতু চূড়ান্ত হয় নাই, এটি এখন প্রকাশ করা হবে না। আর অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা চলছে। কতদিনে সরকার হবে, এসব বিষয়ে আলোচনা চলছে।
গণমাধ্যমের ওপর হামলার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা সকলকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য ভূমিকা রাখতে আহ্বান জানাচ্ছি। ছাত্র–জনতা এই অভ্যুত্থান করেছে। এখন এই অভ্যুত্থানকে রক্ষা করার, এই নতুন বাংলাদেশ গঠন করার দায়িত্ব তাদের। আমরা দেখেছি, বিভিন্ন ধরনের নাশকতা করা হচ্ছে, হামলা করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে; করে এই আন্দোলকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা সকলের প্রতি আহ্বান থাকবে, এই ধরনের হামলা লুটপাট, হামলা রুখে দেবেন। এবং যারা সংবাদকর্মী আছেন, তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন এবং আপনারা প্রয়োজনে পাহারা দেবেন।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা গণহত্যা ও দুর্নীতিতে জড়িত ছিল, তাদেরকে আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনা হবে। কেউ আপনারা আইন হাত তুলে নেবেন না। আমরা সহিংসতা, রক্তপাত চাই না; আমরা একটি শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ চাই।
এদিকে বঙ্গভবন থেকে জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, দেশ এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ সংকট উত্তরণে যত দ্রুত সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা জরুরি। উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যান্য সদস্য মনোনয়ন এর ক্ষেত্রে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন। এছাড়া তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে মনোনয়ন দেওয়ার পরামর্শ দেন। রাষ্ট্রপতি সংকট উত্তরণে দেশবাসীকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ জন সমন্বয়ক উপস্থিত ছিলেন।