ড. আবদুল করিম : মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস চর্চার পথিকৃৎ

কানিজ ফাতেমা | সোমবার , ২৪ জুলাই, ২০২৩ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

অধ্যাপক ড. আবদুল করিম ছিলেন প্রখর মেধাবী, জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান এবং ধীশক্তি সম্পন্ন উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ। অসংখ্য গ্রন্থ প্রণেতা এ প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ একাধারে শিক্ষকগবেষক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সর্বোপরি একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তি। তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা ইতিহাসের ছাত্রছাত্রী ছাড়াও সংশ্লিষ্ট সকল মহলের জ্ঞানগবেষণার পথ নির্দেশক হিসেবে কাজ করছে। ড. করিমের ইতিহাস চর্চার মূল বিচরণ ক্ষেত্র হলো বাংলার ইতিহাসের মধ্যযুগ তথা মুসলিম শাসিত বাংলার ইতিহাস। গভীর অনুসন্ধিৎসা, একনিষ্ঠ অনুশীলন, মেধা ও মনন, নিরলস প্রচেষ্টা, পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং ভাষাগত পাণ্ডিত্যের কারণে তিনি মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসের নতুন নতুন দিক উন্মোচন করে একজন সত্যানুসন্ধানী ইতিহাসবিদ হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আবদুল করিম ১ জুন ১৯২৮ সালে চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার চাঁপাছড়ি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ ওয়াইজ উদ্দিন ও মাতা সৈয়দা রাশিদা খাতুন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। শিক্ষার হাতেখড়ি মৌলভী মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান চৌধুরীর নিকট। এরপর তিনি চাঁপাছড়ি ও বাহারছড়া গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন এবং বৈলছড়ি জুনিয়র মাদ্রাসা থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করে ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমানে হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ) সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ২য় স্থান এবং ১৯৪৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৮ম স্থান অধিকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক সম্মান এবং ১৯৫০ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করে আবদুল করিম নারায়ণগঞ্জ জেলার মুড়াপাড়া ভিক্টোরিয়া কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ১৯৫১ সালের শেষের দিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ইতিহাসবিদ আবদুল হালিম এর অনুপ্রেরণা ও পরামর্শে বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ আহমদ হাসান দানীর তত্ত্বাবধানে আবদুল করিম গবেষণাকর্মে মনোনিবেশ করেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “Social History of the Muslims in Bangla Down To A.D.1538” শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৬০-’৬২ সালে ইতিহাসবিদ জে. বি. হ্যারিসনের গবেষণাতত্ত্বাবধানে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন School of Oriental and African Studies থেকে Murshid Quli Khan and His Times” শিরোনামে অভিসন্দর্ভ রচনা করে স্বল্প সময়ে দ্বিতীয়বার পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ড. করিম ইতিহাস বিভাগে রিডার ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।

করিম স্যারের মতে, শিক্ষকতায় ভালো করতে হলে বিষয়ের উপর ব্যাপক দখল থাকা জরুরি এবং পঁয়তাল্লিশ মিনিটের একটি ক্লাসের প্রস্তুতির জন্যে পঁয়তাল্লিশ ঘন্টা পড়তে হবে। আবদুল করিম হয়ে উঠার পেছনের গল্প সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “যার মোহর আলীর মতো ছাত্র নেই, তার ভালো শিক্ষক হওয়ার সুযোগ নেই”। শিক্ষকতা পেশার শুরুতেই তিনি ছাত্র হিসেবে মোহর আলীকে পেয়েছিলেন। যত প্রস্তুতিই নিয়ে যেতেন ক্লাসে, মোহর আলীর প্রশ্নে এলোমেলো হয়ে যেতেন। মোহর আলীকে জিজ্ঞেস করেনতোমাকে কি কেউ আমাকে হেনস্তা করার জন্য পাঠিয়েছে? স্যারের এমন প্রশ্নের জবাবে মোহর আলী বলেন, জ্বি না স্যার। আপনার মতো এতো পড়াশুনা করে আর কেউ ক্লাসে আসে না। আমি ভেবেছি এই কোর্সের জন্য আপনি যে ক’টা বই পড়েন, তার চেয়ে প্রতিদিন আমি একটি হলেও বেশি বই পড়ে আসবযা ছিল মোহর আলীর চ্যালেঞ্জ। তার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে করতেই তিনি হয়ে উঠেন আবদুল করিম। অধ্যাপক করিমের ছাত্রদের মধ্যে এই মোহর আলীই সবচেয়ে মেধাবী এবং পরবর্তীতে ইতিহাসবিদ হিসেবে তার স্বাক্ষরও রেখেছিলেন। মোহর আলীর চার () খন্ডের ‘History of Moslim Bangla’ বাঙালি ঐতিহ্যের স্বাতন্ত্র্যিক আইডেন্টিটি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অধ্যাপক করিমের গবেষণা ও প্রকাশনাকর্ম বিশাল। তাঁর প্রকাশিত ইংরেজি গ্রন্থের সংখ্যা ১০টি, বাংলা গ্রন্থের সংখ্যা ২৪টি, প্রকাশিত ইংরেজি প্রবন্ধ ৭২টি, বাংলাপিডিয়ায় লিখিত ভুক্তির সংখ্যা ১২০টি, প্রকাশিত বাংলা প্রবন্ধ ৮৫টি, গ্রন্থ সমালোচনা ইংরেজি ৪টি, বাংলা ৫টি, মুখবন্ধ ও ভূমিকা (বাংলা) ১২টি। করিম স্যারের রচনারীতি স্বচ্ছ, সাবলীল এবং প্রাণবন্ত। তিনি ঘটনার বর্ণনামূলক, জীবনচরিত ভিত্তিক, ধর্মীয়, মুদ্রাতত্ত্বীয়, শিলালিপি তত্ত্বীয় প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। ‘Social History of the Muslims in Bangla ’ গ্রন্থটি ড. আবদুল করিম রচিত সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। বইটি তাঁর পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভের ভিত্তিতে রচিত। এই গ্রন্থটি রচনার মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারা ভেঙে সামাজিক ধারায় ইতিহাস চর্চার রীতি চালু করেন এবং প্রমাণ করেন এই উপমহাদেশে প্রাক্‌ঔপনিবেশিক যুগও স্বর্ণময়। তিনি প্রাচীন ভারত থেকে গবেষণার ঝোঁক মধ্যযুগের দিকে নিয়ে এসেছিলেন। ‘Murshid Quli Khan and His Times’ গ্রন্থটি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর দ্বিতীয় পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভের ভিত্তিতে রচিত। গ্রন্থটিতে তিনি মুর্শিদকুলী খানের শাসনকাল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করেন এবং তৎকালীন ইউরোপীয় কোম্পানির সঙ্গে নবাবের সম্পূর্ণ বাংলার ব্যবসায়বাণিজ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক জীবনের উপর মুর্শিদকুলী খানের প্রভাব তাঁর গবেষণায় স্থান পেয়েছে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি তাঁর গবেষণায় মুর্শিদকুলী খানকে একজন প্রভুভক্ত অথচ যোগ্য প্রাদেশিক শাসক হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।

ইতিহাসবিদ আবদুল করিম মুসলিম শাসকদের মুদ্রা বিশ্লেষণ করে ‘Corpus of the Muslim Coins of Bangla (down to A.D 1938)’ গ্রন্থ রচনা করেন। বইটি তাঁকে Numismatic Society of India কর্তৃক একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে Akbar’s Silver Medal(1960) স্বীকৃতি এনে দেয়। তিনি পরবর্তী গবেষকদের জন্য ১৯৭৬ সালে মুদ্রাবিষয়ক ভাণ্ডার ‘Catalogue of Conis in the Cabinet of the Chittagong University Museum’ এবং শিলালিপি অধ্যয়ন করে ১৯৯২ সালে ‘Ocorpus of the Arabic and Persian Inscriptions of Bangla’ গ্রন্থ রচনা করেন। আবদুল করিম মাদ্রাসায় ছাত্র থাকাকালীন আরবী ও ফার্সী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন যা মুদ্রা ও শিলালিপি গবেষণাকে সহজতর করে। মধ্যযুগের বাংলার মুদ্রা ও শিলালিপি অধ্যয়ন এবং বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক করিম একদিকে নিজে যেমন সুলতানি এবং মুগল আমলের বাংলার সামাজিকসাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস রচনার নতুন দিক উন্মোচন করেছেন, অন্যদিকে ভবিষ্যত গবেষকদের যাত্রাপথ করেছেন আলোকিত। ‘Dacca The Mughal Capital’ . করিমের আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। গ্রন্থটি রচনার উপাত্ত খুঁজতে গিয়ে তিনি ডাচ ভাষাও আয়ত্ত করেছিলেন। এ গ্রন্থটির প্রধান গুরুত্ব হচ্ছে এটি বাংলার ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণের কালপুঞ্জিকে সঠিকভাবে তুলে ধরেছে। এটিই সম্ভবত প্রথম গবেষণামূলক গ্রন্থ যা আমাদের দেশে নগর এবং নগরায়ন সম্পর্কে গবেষক ও ছাত্রদের গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। এছাড়া ‘ঢাকাই মসলিন’, ‘বাংলার ইতিহাস : সুলতানী আমল’ (গবেষকদের বিচারে শ্রেষ্ঠ মৌলিক কর্ম), বর্তমান রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তিনি ২৬ বছর আগে লিখেছেন ‘The Rohingyas : A Short Account of Their History and Culture ’, চট্টগ্রামে ইসলাম ও ঐতিহ্য, বাংলা সাহিত্যের কালক্রম সহ আরো অনেক মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন।

বাংলার ইতিহাস চর্চার পাশাপাশি ড. আবদুল করিম অসাধারণ সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। একজন প্রশাসক হিসেবে তিনি বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। এ গুণী শিক্ষাবিদ একাধারে হাউস টিউটর, প্রভোস্ট, ডিন এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ মেয়াদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক, প্রশাসনিক ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিডার ইনস্টিটিউট হিসেবে ১৯৬৮ সালে ‘হাটহাজারী কলেজ’, ‘বাঁশখালী কলেজ’ এবং ১৯৯৫ সালে ‘পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় ডিগ্রি কলেজ’ প্রতিষ্ঠায় মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। সুদীর্ঘসময় শিক্ষকতার মহান দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮৪ সালে অবসর গ্রহণের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘Institute of Bangladesh Studies ’ এ সিনিয়র ফেলো হিসেবে যোগ দেন। এ সময়ে (১৯৮৯১৯৯০) তিনি দুই খন্ডে ‘বাংলায় মুগলদের ইতিহাস’ রচনা করেন। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ‘সুপারনিউমেরারি প্রফেসর’ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সুদীর্ঘ গবেষণাজীবনে ইতিহাস চর্চা ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অধ্যাপক আবদুল করিম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৯৫ সালে ‘একুশে পদক’ সম্মাননা লাভ করেন। তিনি ১৪ জানুয়ারি ২০০১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রথম ‘ইমেরিটাস প্রফেসর’ পদে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু উক্ত পদে নিয়োজিত ছিলেন।

উপমহাদেশের খ্যাতিমান এই ইতিহাসবিদ ২৪ জুলাই ২০০৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধেয় স্যারের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবনকে ড. আবদুল করিম ভবন নামকরণ করা হয়। অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী, জ্ঞানতাপস, সফল গবেষক ও গুণী এই ইতিহাসবিদ আমাদের সবার কাছে এক অনুপম আদর্শ ও চিরন্তন প্রেরণার উৎস। এই সমাজের মানুষ যে তাঁর ছায়াতলে যেতে চায় তা বোধ করি তিনি তাঁর দীর্ঘজীবনে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও যে কারো ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারতেন না। সমাজের মানুষকে তিনি বড় আপনজন মনে করতেন এবং ডাকে সাড়া দেওয়াটাকে মনে করতেন তাঁর জীবনের এক অন্যতম বড় কাজ। বিনয়ী, সদালাপী, অমায়িক সর্বোপরি একজন শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধেয় স্যার তাঁর প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থী ও গবেষণাকর্মের মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগান্তর।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসহাক মিয়া : বাবাকে যেমন দেখেছি
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল