সংঘাত ও চলমান উত্তেজনার মধ্যে একে অন্যের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ভূপাতিত করার পাল্টাপাল্টি দাবি করেছে ভারত ও পাকিস্তান। ভারতের সেনাবাহিনী দাবি করছে, পাকিস্তান ভারত–শাসিত কাশ্মিরের উধমপুর এবং পাঞ্জাবের পাঠানকোটের তিনটি সামরিক স্থাপনায় গতকাল রাতে ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়েছে। তবে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভারতের এই অভিযোগ নাকচ করে বলেছেন, ভারত শাসিত কাশ্মীরে কোনো হামলার দায় তার দেশের নয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছে, ওইসব ‘হামলা’র ফলে তাদের কোনোরকম ক্ষয়ক্ষতি হয় নি এবং হামলাগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী ভারত সরকারকে ‘সিনেমা’ থেকে ‘বাস্তব’ জগতে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান যখন ভারতে হামলা করবে, তখন এর প্রতিধ্বনি সব জায়গায় শোনা যাবে।’
বিবিসির বাংলার খবরে বলা হয়, গত রাতে জম্মু অঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, পুরো জম্মু শহরই অন্ধকার করে দেওয়া হয়েছে। জম্মুর বিমানবন্দর থেকে বিস্ফোরণের খবর আগেই পাওয়া গিয়েছিল। সেখান থেকে প্রায় দেড় ঘন্টা দূরের কাঠুয়া থেকেও বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া গেছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। সেখানেও ব্ল্যাক আউট করে দেওয়া হয়েছে পুরো শহর। শুধু জম্মু নয়, সীমান্ত সংলগ্ন পাঞ্জাবের বিভিন্ন অংশেও ‘ব্ল্যাকআউট’ করা হয়েছে। অমৃতসর. চণ্ডীগড়েও ‘ব্ল্যাকআউট’ করা হয়েছে। বেজেছে সাইরেন। পাকিস্তানের হামলার আবহে ভারতের ২৪টি বিমানবন্দর বন্ধ রাখা হল। ফ্লাইটরাডার২৪–এর তথ্য বলছে, এই সপরিস্থিতিতে ভারতের পশ্চিম প্রান্ত বিশেষ করে কাশ্মীর থেকে গুজরাত পর্যন্ত আকাশপথে বিমান চলাচল প্রায় বন্ধ। ভারতের কিছু সংবাদ মাধ্যম দাবি করেছে, পাকিস্তানের হামলার জবাবে ইসলামাবাদ, সিয়ালকোট, লাহোরে পাল্টা হামলা করেছে ভারত। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কিছু জানায়নি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও এর সত্যতা নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ গতকাল সর্বদলীয় বৈঠকে দাবি করেছেন, ‘অপারেশন সিঁন্দুুর’–এর মাধ্যমে শতাধিক সন্ত্রাসীকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, তারা যদি এই পর্যায় থেকে সংঘাত আরো বাড়ানোর চেষ্টা করে তাহলে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। অপারেশন সিন্দুরকে একটি ‘চলমান অভিযান’ বলেও বর্ণনা করেন রাজনাথ সিংহ। ভারত সরকার জানিয়েছে, কাশ্মীরের পেহেলগাম হামলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান সীমান্তে গোলাগুলি শুরু করেছিল, যত দিন গেছে ততই এর তীব্রতাও বেড়েছে। এতে এখন পর্যন্ত তিন নারী ও পাঁচ শিশুসহ ১৬ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এক ভারতীয় সেনারও প্রাণ গেছে।
এদিকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে যে সফট–কিল (কারিগরিভাবে) এবং হার্ড–কিল (অস্ত্রের মাধ্যমে) পদ্ধতিতে অন্তত ২৯টি ইসরায়েলে তৈরি হেরোপ ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। পাকিস্তানের ধ্বংস করা এসব ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তান ভারতের বিমান ও ড্রোন ধ্বংস করার পর তারা (ভারত) ইসরায়েলি তৈরি হেরোপ ড্রোন দিয়ে পাকিস্তানে আক্রমণ করছে যা ভারতের উদ্বেগ এবং আতঙ্কের লক্ষণ।
দুইজন মার্কিন কর্মকর্তার বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, চীনে নির্মিত পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান বুধবার অন্তত দুটি ভারতীয় সামরিক বিমান ভূপাতিত করেছে, যা বেইজিংয়ের উন্নত যুদ্ধবিমানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর একজন মুখপাত্র রয়টার্স প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
চলমান সংঘাতে আইপিএলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গতকাল হঠাৎ ফ্লাডলাইট নিভে ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ার পর ধর্মশালা থেকে পাঞ্জাব কিংস ও দিল্লি ক্যাপিটালসের খেলোয়াড়দের সরিয়ে নেওয়ার জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। বাকি টুর্নামেন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার পর বোর্ডের সহ–সভাপতি রাজিব শুক্লা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে শুক্রবার (আজ) সিদ্ধান্ত নেবেন তারা। ধর্মশালার হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার দিল্লির বিপক্ষে পাঞ্জাবের ইনিংসের মাঝপথে একে একে নিভে যায় তিনটি ফ্লাডলাইট টাওয়ার। ‘নিরাপত্তা শঙ্কায়’ মিনিট দশেক পরই ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
এদিকে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে গতরাতে হওয়ার কথা ছিল এমন একটি ক্রিকেট ম্যাচের সময়সূচি পরিবর্তন করা হয়েছে। এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। ভারতীয় ড্রোন হামলায় রাওয়ালপিন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তা নিশ্চিত করেনি। তবে সেনাবাহিনী জানিয়েছে স্টেডিয়ামের কাছাকাছি একটি রাস্তায় ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত হয়েছিল।
যেসব বিষয়ে কথা বলেননি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব : বিবিসি বাংলা জানায়, পাকিস্তান পাঁচটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে এমন দাবির বিষয়ে প্রশ্ন করলে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। বুধবার দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে মিশ্রি বলেন, এই বিষয়ে সরকারি তথ্য সঠিক সময়ে জানানো হবে। পাকিস্তানি বাহিনী ৫০ জন ভারতীয় সেনা হত্যা করেছে বলে সেখানকার তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারারের দাবির বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়নি মিশ্রিকে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। কিছু ভারতীয় গণমাধ্যমের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, গতকাল বুধবার পাকিস্তানে বিমান হামলায় ১০০ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে। কিন্তু এই দাবির বিষয়ে কথা বলেননি তিনি। তিনি বলেন, এই বিমান হামলার পর মাত্র ৩৬ ঘণ্টা পার হয়েছে এবং আরো বিস্তারিত জানার জন্য গণমাধ্যমকে অপেক্ষা করতে বলেন। পাকিস্তানের লাহোরে একটি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভারত নিষ্ক্রিয় করেছে উল্লেখ করে এমন আরো কোনো লক্ষ্যবস্তু ভারতের তালিকায় রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযানের বিস্তারিত জানাবেন না। যদিও পাকিস্তান, লাহোরে তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত হানার কথা অস্বীকার করেছে।