ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল, চীনের ঐতিহ্যের রূপ

হাসান আকবর, সাংহাই (চীন) থেকে | বুধবার , ১২ জুন, ২০২৪ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

এশিয়ার সবচেয়ে বর্ণিল ও প্রাচীনতম উৎসব হিসেবে খ্যাত চীনের ঐতিহ্যবাহী ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল ঘিরে চীনের ঘরে ঘরে সাজ সাজ রব। নৌকা ভাসানো, সর্বশক্তি নিয়ে দল বেঁধে নৌকা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়েছে। বাসাবাড়ি সাজানোর পাশাপাশি করা হয়েছে আলোকসজ্জা। তৈরি হয়েছে বিশেষ খাবার জংজি। অতিথিদের বিশেষ এই খাবার দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়েছে। এদিন প্রচুর উপহার বিনিময় হয়।

ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল চীনের ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষিতে সূচিত হলেও এশিয়াজুড়ে এই উৎসবের জয়জয়কার। নৌকা বাইচ কেন্দ্রিক বিশেষ এই অনুষ্ঠানের ধর্মীয় গুরুত্বও রয়েছে। চীনসহ সন্নিহিত অঞ্চলের দেশগুলোর আস্তিকনাস্তিক সব মানুষের মাঝে এই উৎসব দারুণ আবহ তৈরি করে। শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নন, অন্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষও এই উৎসব ঘিরে আনন্দ করে। চীনাদের হিসেবে প্রতি বছর পঞ্চম চন্দ্র মাসের ৫ তারিখ এই উৎসব হয়। দিনটি সরকারি ছুটির দিন। দুই হাজার বছর ধরে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গতকাল উৎসাহ উদ্দীপনা এবং উৎসবমুখর পরিবেশে এবারের ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার নারীপুরুষ নৌকা বাইচ উপভোগ করে। একাধিক চীনা পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঐতিহাসিক এক বিয়োগান্ত ঘটনা থেকে এই উৎসবের প্রচলন। উৎসবের সূচনা নিয়ে চীনের মানুষের মাঝে মতানৈক্য থাকলেও উৎসবে আয়োজনের কমতি থাকে না। তিনটি ঘটনার যেকোনো একটি থেকে যে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা হয়েছিল সেই সম্পর্কে সবাই একমত। ঘটনা তিনটি চীনাদের মুখে মুখে। এর মধ্যে একটি ঘটনাকে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরশীল বলে মনে করেন অধিকাংশ চীনা নাগরিক। তারা বলেন, চৈনিক সভ্যতা কয়েক হাজার বছরের। হোয়াংহো নদীর তীরে চৈনিক যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ইতিহাস ধারণ করে। তাদের মতে, ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা প্রায় ২ হাজার ২০০ বছর আগের এক ঐতিহাসিক বিয়োগান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ওই সময় বিশাল চীনে খণ্ড খণ্ড অনেক স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ওই সময় মিলুও নদীর দু পাশের উর্বর বসতি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল চু নামের একটি রাজ্য। এই রাজ্যে কু ইউয়ান নামে ভালো মানুষ একজন কবি ছিলেন। তিনি শুধু কবি ছিলেন না, রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও ছিলেন। রাজ্য এবং রাজ্যের মানুষের উন্নতি এবং সুখশান্তি নিশ্চিত করতে কাজ করতেন। এতে করে দিনে দিনে তিনি রাজা এবং প্রজাদের প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেন। কিন্তু শত্রুরও জন্ম হয়। কু ইউয়ানেরও হয়েছিল। রাজসভার কতিপয় সদস্য রাজাকে তাঁর সম্পর্কে নানা কল্পকাহিনী বুঝিয়ে কান ভারী করেন। এক পর্যায়ে রাজাও বিশ্বাস করেন। কু ইউয়ানকে রাজসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়, শাস্তি দেওয়া হয়।

বিতাড়িত কু ইউয়ান অপদস্ত হয়ে একাকী থাকেন। ওই সময় রাজ্যে প্রতিপক্ষ রাজ্যগুলো থেকে দফায় দফায় হামলা চালানো হয়। চালানো হয় ধ্বংসযজ্ঞ। খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজে সুখী রাজ্যটির বাসিন্দাদের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এমন দুর্দিনে মানুষের জন্য কিছু করতে না পারার বেদনায় পঞ্চম চন্দ্র মাসের ৫ তারিখ কু ইউয়ান একটি কবিতা লিখেন। কবিতাটা লিখে শেষ করার পর তিনি মিলুও নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। একজন ভালো মানুষের এবং কবির আত্মহত্যার ঘটনায় পুরো রাজ্যে হাহাকার ওঠে। তারা দল বেঁধে নৌকা নিয়ে মিলুও নদীতে কু ইউয়ানের মরদেহের সন্ধান করতে থাকেন। কিন্তু মরদেহ পাওয়া যাচ্ছিল না। ওই সময় এক ব্যক্তি ভাতের গোলাকার পিণ্ড বানিয়ে নদীতে ছুড়তে থাকেন এবং বলতে থাকেন, যতক্ষণ এই নদীর মাছগুলো এই খাবার পাবে ততক্ষণ তারা কু ইউয়ানের শরীর স্পর্শ করবে না। চীনাদের বিশ্বাস, ওই ঘটনার পর থেকেই ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা। কালের বিবর্তনে যা বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে।

অপর একটি বিয়োগান্ত ঘটনা থেকে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা বলে বিশ্বাস চীনাদের। সেটিও প্রায় দুই হাজার বছর আগের ঘটনা। শত্রুদের মিথ্যাচারে রুষ্ট হয়ে একজন সম্মানিত শিক্ষক এবং তার বড় পুত্রকে রাজা ফাঁসিতে ঝুলান। ওই শিক্ষকের ছোট পুত্র পরে পাশের রাজ্যে আশ্রয় নেন। বেশ কয়েক বছর পর শিক্ষকপুত্র পাশের রাজার প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন এবং ওই রাজাকে নিয়ে পিতা এবং ভাই হন্তারক রাজার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে রাজা, রাজপুত্র, রানিদের হত্যা করে রাজ্য দখল করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আবার শত্রুদের মিথ্যাচারে ক্ষুদ্ধ হয়ে রাজা তাকে ফাঁসিতে ঝুলান। এই মৃত্যুর পরও রাজ্যজুড়ে হাহাকার ওঠে; যা স্মরণীয় করে রাখতে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা হয় বলে জিয়াংশু ও ঝেইজিয়াং অঞ্চলের বাসিন্দাসহ অনেক চীনা বিশ্বাস করেন।

তৃতীয় ঘটনাটি পিতার প্রতি কন্যার দুর্দান্ত ভালোবাসার। প্রাচীন হান রাজবংশ শাসিত রাজ্যে পানিতে ডুবে মারা যান এক ব্যক্তি। কিন্তু কয়েকদিন খোঁজাখুঁজি করেও ওই ব্যক্তির মরদেহের সন্ধান মিলে না। তার একটি মেয়ে ছিল। ঘটনার ১৭ দিন পর পঞ্চম চন্দ্র মাসের ৫ তারিখ মেয়েটি পিতার মরদেহের খোঁজে নদীতে নামে এবং লাশ নিয়ে উঠে আসে। পিতার প্রতি মেয়ের ভালোবাসাকে স্মরণীয় করে রাখতে স্থানীয় লোকজন নদীর পাড়ে একটি মন্দির বানায়। এরপর থেকে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা বলে প্রচলিত রয়েছে।

ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল মূলত নৌকা বাইচ। এই দিনে চীনের নানা অঞ্চলে বর্ণাঢ্য সাজে সুসজ্জিত নৌকা নিয়ে বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। ড্রাগন চীনের জাতীয় প্রতীক। নৌকাগুলোর সাজসজ্জায় ড্রাগনের ছবি ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো নৌকার দুই প্রান্তে ড্রাগনের আকৃতি দেওয়া হয়। তাই ফেস্টিভ্যালের সাথে ড্রাগন শব্দটি যুক্ত হয়েছে। এদিনের জনপ্রিয় এবং ব্যাপক ব্যবহৃত খাবার হচ্ছে ‘জংজি’। কলাপাতার ভেতর বিন্নিভাতের মতো আটালো ভাতে নানা প্রাণীর মাংস দিয়ে গোলাকৃতির জংজি বানানো হয়। অনেকটা সিঙ্গারার মতো। সুতলি দিয়ে কলাপাতা বেঁধে ভাপে রান্না করা হয়। এই খাবার দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। এদিন পুরো চীন উৎসবে মাতে। নানা আচার ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা দিনটি পালন করে। ধর্মবিশ্বাসী চীনারা মনে করেন, এসব আচার পালনের মাধ্যমে পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন অশুভ শক্তি থেকে মুক্তি পায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম অংশে ‘বঙ্গবন্ধু ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি’র যাত্রা শুরু
পরবর্তী নিবন্ধবিনামূল্যে সরকারি বাড়ি গৃহহীনদের আত্মমর্যাদা এনে দিয়েছে : প্রধানমন্ত্রী