গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের দায়ে ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনসহ ৪৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং তাদের ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা জরিমানা করেছে আদালত। এর মধ্যে রফিকুল আমিনকে ১২ বছর কারাদণ্ড এবং ২০০ কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৩ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। আর হারুন-অর-রশীদকে ৪ বছর কারাদণ্ড এবং সাড়ে ৩ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক। দশ বছর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা এ মামলায় ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ সোসাইটির প্রায় ১ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছিল এ মামলায়। তাতে অভিযুক্ত ৪৬ আসামির সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করে ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম গতকাল বৃহস্পতিবার এই রায় দেন। এক হাজার পৃষ্ঠার রায়ে বলা হয়, ডেসটিনির যেসব সম্পত্তি ও ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা ইতোমধ্যে অবরুদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হল। আর আসামিদের কাছ থেকে আদায় করা জরিমানার টাকা ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৫ (বি) ধারা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ বাবদ ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের সকল শেয়ারহোল্ডার এবং বিনিয়োগকারীদের সমান হারে ভাগ করে দিতে হবে। সেজন্য সরকারকে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে রায়ে। কমিটির চেয়ারম্যান হবেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা, সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা, একজন উপ- মহা পুলিশ পরিদর্শক, একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট এবং সমবায় বিভাগের রেজিস্ট্রিার। খবর বিডিনিউজের।
মামলার তথ্য অনুযায়ী, মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের নামে ডেসটিনি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল ১ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। সেখান থেকে ১ হাজার ৮৬১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। তাতে সাড়ে ৮ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতির মুখে পড়েন।
এই এমএলএম কোম্পানির এমডি রফিকুল আমীনকে এ আইনের সর্বোচ্চ সাজা ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলেও গ্রুপের প্রেসিডেন্ট হারুনের সাজা কেন কম হল, সেই ব্যাখ্যাও আদালত দিয়েছে।
বিচারক বলেন, ‘হারুন-অর-রশিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের কারণে তাকে সর্বনিম্ন দণ্ডে দণ্ডিত করা হল।’
হারুনের অবরুদ্ধ সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাবে অবমুক্ত (রিলিজ) করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে। তবে জরিমানার তিন কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা তাকে পরিশোধ করতে হবে।
সাবেক এ সেনাপ্রধানের আইনজীবী এ রায়ের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে আপিল করার কথা বলেছেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী একে একটি ‘মাইলফলক রায়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
৩৯ জনই পলাতক : আসামিদের মধ্যে রফিকুল আমীন ও মোহাম্মদ হোসেন কারাগারে ছিলেন। রায় ঘোষণার আগে তাদের আদালতে হাজির করা হয়। হারুন-অর-রশিদ, দিদারুল আলম, জেসমিন আক্তার, জিয়াউল হক ও সাইফুল ইসলাম জামিনে থেকে আদালতে হাজির হন। রায়ে আদালত বলে, আসামিদের মধ্যে যারা এ মামলায় যতদিন হাজতবাস করেছেন, ততদিন সাজার মেয়াদ থেকে বাদ যাবে। জামিনে থাকা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ দিদারুল আলমের সাজার ৮ বছর মেয়াদ আগেই খাটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেজন্য তাকে রায়ের পর আদালত থেকেই চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। আর রায়ে তাকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হলেও বিচারক তা মওকুফ করে দেন। ফলে ওই টাকা তাকে আর দিতে হবে না। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারুন অর রশিদসহ বাকি ছয় আসামিকে সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। মামলায় বাকি ৩৯ জন আসামি পলাতক রয়েছেন। গ্রেপ্তার হলে বা আদালতে আত্মসমর্পণ করলে, তার পর থেকে তাদের সাজার মেয়াদ হিসাব করা হবে।
প্রতিক্রিয়া : রায় ঘোষণার পর দুর্নীতি দমন কমিশনের বিশেষ পিপি মীর আব্দুস সালাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি একটি মাইলফলক রায়। মাল্টিপারপাস কোম্পানি গঠন করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা আত্মসাৎ এবং তা পাচার করায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে।’
অন্যদিকে সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদকে ‘নির্দোষ’ দাবি করে তার আইনজীবী এম মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘হারুন-অর-রশিদ ডেসটিনির কোনো টাকা আত্মসাৎ করেননি। তার অ্যাকাউন্টে একটি টাকাও যায়নি। ডেসটিনির কোনো সম্পত্তি বা টাকা-পয়সা তিনি লেনদেন করেননি। তাকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তা বেআইনি। আমরা এই রায়ে ক্ষুব্ধ। এই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা মহামান্য হাইকোর্টে আপিল করব।’ রায়ের পর হারুনকে নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায়, তিনি কোনো কথা বলেননি। এজলাসে উপস্থিত রফিকুল আমীনসহ অন্য আসামিরাও নিশ্চুপ ছিলেন। হারুন অর রশিদকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়ার আবেদন করেন তার আইনজীবী। আদালত কারা বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। রায়ের পর হারুন আদালতের বেঞ্চে বসে ছিলেন প্রায় দুই ঘণ্টা। কয়েকজন বন্ধু-স্বজনের মাঝে তাকে বার কয়েক চোখ মুছতে দেখা যায়।
মামলা বৃত্তান্ত : দুদকের উপ পরিচালক মো. মোজাহার আলী সরদার ও সহকারী পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম ২০১২ সালের ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডেসিটিনির কর্তাব্যক্তিসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি এবং ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন প্রজেক্টের অর্থ আত্মসাতের দুটি মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ৫ মে দুদক আদালতে উভয় মামলার অভিযোগপত্র দেয়। এর মধ্যে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির মামলায় ৪৬ জন এবং ডেসটিনি ট্রি প্লানটেশন লিমিটেডে দুর্নীতির মামলার ১৯ জনকে আসামি করা হয়। হারুন-অর-রশিদ ও রফিকুল আমিন দুই মামলাতেই আসামি।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০০৮ সাল থেকে মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ প্রোজেক্টের নামে ডেসটিনি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল ১ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। সেখান থেকে ১ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয় বলে দুদকের অনুসন্ধানে ধরা পড়ে। ওই অর্থ আত্মসাতের ফলে সাড়ে ৮ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতির মুখে পড়েন। আর ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন প্রোজেক্টের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ২ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ২ হাজার ২৫৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা আত্মসাত করা হয়। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাড়ে ১৭ লাখ বিনিয়োগকারী। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেসটিনি গ্রুপের নামে ২৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল নামসর্বস্ব। আসামিরা প্রথমে প্রজেক্টের টাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা করতেন, তারপর বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে তা স্থানান্তর করা হত। দুদক ৩৪টি ব্যাংকে এ রকম ৭২২টি হিসাবের সন্ধান পায়, যেগুলো পরে জব্দ করা হয়। আত্মসাৎ করা চার হাজার ১১৯ কোটি টাকার মধ্যে ৯৬ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগও আনা হয় দুই মামলায়। এর মধ্যে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির মামলাটিতে রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২০২ জনের সাক্ষ্য শুনে রায় দিল আদালত। ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেডের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা এখন সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।