গত শনিবার দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, চলতি বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৮৮ ভাগ রোগীর মধ্যে পাওয়া গেছে ডেন–২ ভেরিয়েন্টে ডেঙ্গু ভাইরাস। ১১ ভাগ রোগীর মধ্যে পাওয়া গেছে ডেন–৩ ভেরিয়েন্ট। এছাড়া গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জিনোম সিকুয়েন্স করে দেখা গেছে, ৫০ ভাগ রোগীর মাঝে বিপজ্জনক কসমোপলিটন ধরন উপস্থিত, যা রোগের তীব্রতা ও জটিলতা বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া ডেন–৩–এ সিভিয়ারিটি কম, ডেন–২–এ বেশি। ডেন–২ এর সাব গ্রুপ বেশি সিভিয়ার সিম্পটম নিয়ে প্রেজেন্ট করে, তাই মৃত্যুর হার বেশি। কসমোপলিটন হচ্ছে ডেন–২ এর একটি সাব গ্রুপ। গত দুই বছর ধরে চট্টগ্রামের ডেঙ্গু রোগীদের নিয়ে গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে পাওয়া কসমোপলিটন লিনিয়েজ বাংলাদেশে নতুন। বাংলাদেশের অন্য সব অঞ্চল থেকে পাওয়া আগেকার প্রকরণগুলো থেকে চট্টগ্রামে পাওয়া প্রকরণটি উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। ফাইলোজেনেটিক বিন্যাস তথা তুলনামূলক বিশ্লেষণে পাওয়া যায়, এই প্রকরণগুলো মিয়ানমার এবং ভারতে প্রবাহিত হচ্ছে। গবেষকগণ ধারণা করছেন পর্যটক ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের মাধ্যমে এই বিপজ্জনক প্রকরণটি দেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এই প্রকরণ ডেঙ্গুর তীব্রতা ও মৃত্যুহার বাড়িয়ে দেয়। এই জিনোম সিকুয়েন্সগুলো জিনোমের উন্মুক্ত বৈশ্বিক তথ্যভান্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটায় (জিআইএসএআইডি) গৃহীত হয়েছে। এছাড়া এই গবেষণার দুটি গবেষণাপত্র ইউরোপিয়ান জার্নাল অব মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনলজি এবং আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিনে গৃহীত হয়েছে।
২০২৪ সালে চলমান এই প্রকল্পে আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই গবেষণাদলে আছেন চমেক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবদুস সাত্তার ও ডা. আবুল ফয়সাল মো. নুরুদ্দিন চৌধুরী, চবি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান এবং এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও চমেকের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আবদুর রব। গবেষকগণ মনে করেন, ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য জিনোম সিকুয়েন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব তথ্য গুরুত্ব সহকারে সরকার গ্রহণ করলে পরবর্তী বছরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ডেঙ্গু নিয়ে কোনো রকম অবহেলা নয়, তার মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। শুধু চট্টগ্রাম নয়, সমগ্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সারাবছর নিয়মিত তদারকি কার্যক্রম চালানো হয় না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কেবল আগাম সতর্কতা জানিয়ে দেওয়া হয়। এতে তাদের দায়িত্ব সারে তারা। সিটি করপোরেশনগুলো আগাম সতর্কতা পাওয়ার পরও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেয় না। বর্তমানে তো মেয়রের জায়গায় কাজ করছেন প্রশাসক। কাউন্সিলররা তো নেই। ফলে অনেকের অভিযোগ, ডেঙ্গু প্রতিরোধের কার্যক্রম চলছে অনেকটা দায়সারাভাবে। এমনকি যখন ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করে তখনও কিছু অনিয়মিত অভিযান ছাড়া তেমন উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ বোধ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। যার ফলে ডেঙ্গু আজ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ আকারে। ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। রেকর্ড মাত্রায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশার বংশবিস্তারে সাহায্য করছে নগরায়ণও। কিছু স্থানে এই রোগ আগে ছিলো না কিন্তু এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এই প্রবণতা এখন বাংলাদেশ ও ভারতে দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্যালিফোর্নিয়া, দক্ষিণ ইউরোপ, আফ্রিকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। কিন্তু জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই। কীটতত্ত্ববিদরা মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার কথা বলেন। এজন্য প্রথমত, চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। কেননা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মশা বেশি জন্মায়। দ্বিতীয়ত, জৈবিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে কোথায় কোথায় মশা বেশি, কোনো ধরনের মশার উপদ্রব বেশি এবং এ মশার জন্য কোন ওষুধ কতটুকু ছিটাতে হবে, তা নির্ণয় করে ওই জায়গায় ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। যেন এসব জায়গায় নতুন করে মশা জন্মাতে না পারে। এছাড়া মশার অতিরিক্ত প্রজনন বন্ধের জন্য জলাশয়ে মাছ, হাঁস ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, রাসায়নিক ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সবশেষ সাধারণ জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। চট্টগ্রামের ডেঙ্গু রোগীদের নিয়ে গবেষণার যে ফল পাওয়া গেছে, তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেই অনুযায়ী ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে জনসাধারণ উপকৃত হবে বলে বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস।