গতকাল দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, শনিবার আরও ৫ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে এক বছরে তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখল বাংলাদেশ। এ হিসেবে এডিস মশাবাহিত এ রোগে এ বছর ১৮২ জনের মৃত্যু হল। এর আগে ২০২৩ সালে ১৭০৫ জন মারা গিয়েছিল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে, যা এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু। তার আগে ২০২২ সালে ২৮১ জন এবং ২০১৯ সালে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল এই রোগে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো ধরনের অবহেলা কাম্য নয়। কেননা, দিন দিন এর প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন অন্তত ১০ কোটি মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে, এরইমধ্যে তা বুঝতে শুরু করেছে বিশ্ব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যানুয়ায়ী, ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারান প্রায় ২০ হাজার মানুষ। আর চলতি বছর বিশ্বে ৪০ হাজার মানুষ মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুধু চট্টগ্রাম নয়, সমগ্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সারাবছর নিয়মিত তদারকি কার্যক্রম চালানো হয় না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কেবল আগাম সতর্কতা জানিয়ে দেওয়া হয়। এতে তাদের দায়িত্ব সারে তারা। সিটি করপোরেশনগুলো আগাম সতর্কতা পাওয়ার পরও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেয় না। বর্তমানে তো মেয়রের জায়গায় কাজ করছেন প্রশাসক। কাউন্সিলররা তো নেই। ফলে অনেকের অভিযোগ, ডেঙ্গু প্রতিরোধের কার্যক্রম চলছে অনেকটা দায়সারাভাবে। এমনকি যখন ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করে তখনও কিছু অনিয়মিত অভিযান ছাড়া তেমন উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ বোধ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। যার ফলে ডেঙ্গু আজ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ আকারে। ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। রেকর্ড মাত্রায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশার বংশবিস্তারে সাহায্য করছে নগরায়ণও। কিছু স্থানে এই রোগ আগে ছিলো না কিন্তু এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এই প্রবণতা এখন বাংলাদেশ ও ভারতে দেখা যাচ্ছে। সাস্প্রতিক বছরগুলোতে ক্যালিফোর্নিয়া, দক্ষিণ ইউরোপ, আফ্রিকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। কিন্তু জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই। কীটতত্ত্ববিদরা মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার কথা বলেন। এজন্য প্রথমত, চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। কেননা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মশা বেশি জন্মায়। দ্বিতীয়ত, জৈবিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে কোথায় কোথায় মশা বেশি, কোন ধরনের মশার উপদ্রব বেশি এবং এ মশার জন্য কোন ওষুধ কতটুকু ছিটাতে হবে, তা নির্ণয় করে ওই জায়গায় ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। যেন এসব জায়গায় নতুন করে মশা জন্মাতে না পারে। এছাড়া মশার অতিরিক্ত প্রজনন বন্ধের জন্য জলাশয়ে মাছ, হাঁস ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, রাসায়নিক ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সবশেষ সাধারণ জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ চারটিকে একত্রে কীটতত্ত্ববিদদের মতে ‘সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা’ বলা হয়।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)-এর কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার লিখেছেন, অনেকবার চেষ্টা করেছি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশক দমনে সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার পরামর্শ প্রদানের। কিন্তু সবসময়ই ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ভগ্ন মনোরথ হয়ে ফিরতে হয়েছে। মশক দমন পদ্ধতি কখনোই যেমন একক কোনো পদ্ধতি নয়, তেমনি কখনোই একক কোনো মানুষের সিদ্ধান্ত জোর করে প্রয়োগের বিষয়ও নয়। এ দমন পদ্ধতি হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সব অংশীজনের সমন্বিত পরামর্শের প্রায়োগিক বিষয়। বিশ্বের সব দেশ মশাবাহিত রোগগুলো সফলভাবে দমনে সক্ষম। সে দেশগুলোর প্রায়োগিক দিক বিশ্লেষণ করে আমাদের দেশের পারিপার্শ্বিক উপাদানের ভিত্তিতে তার প্রয়োগ কতটা সম্ভব, তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ দল কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এর ব্যত্যয় হলে অবশ্যই বিপরীত ফলাফল দেবে। যে কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ রোগের ক্ষেত্রে ইপিডেমিওলজিক্যাল স্টাডির যথাযথ বিশ্লেষণেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই সঠিক পরিসংখ্যানিক তথ্য উপস্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব এবং সেই সঙ্গে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবের সঠিক সম্পর্ক নিরূপণ নিশ্চিত করতে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সহায়তা প্রয়োজন। একইসঙ্গে মশক দমন পদ্ধতির কার্যকারিতা, ডেঙ্গুর চিকিৎসার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে যখন সঠিক গবেষণাভিত্তিক তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে, কেবল তখনই একটি সঠিক প্রায়োগিক পদ্ধতি নির্বাচন করা সম্ভব হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা।