এই বছর (২০২৩ সাল) এখন পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশে। যদিও সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর অবস্থান হলো ব্রাজিলে। তবে তাদের মৃত্যু হার আমাদের থেকে কম। এইটি অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা দানকারী আন্তর্জাতিক সংগঠন ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস, ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (ইসিডিসি) ও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুর পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী। ইসিডিসি ২ অক্টোবর‘ ২৩ সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছে, এমন ১০টি দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করে। যার মধ্যে ৭টি দক্ষিণ আমেরিকার। দেশগুলো হলো ব্রাজিল, পেরু, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, নিকারুগুয়া ও কলম্বিয়া। বাকি তিনটি এশিয়ার। ভারত, বাংলাদেশ ও ফিলিপাইন।
এই বছর দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।এতে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১,২০৬ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২,৪৪,৬৯৮ জন। ঢাকায় ভর্তি হয়েছেন ৯৩,৬৭৯ জন ও ঢাকার বাইরে ১,৫৩,৫১৪ জন। চট্টগ্রামে ভর্তি হয়েছে ১১,৬৩৪ জন এবং মারা গেছে ৮২ জন। এর বাইরে বাসায় চিকিৎসা নিয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। ডেঙ্গুর মৌসুম এখনো শেষ হয়নি। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও ২–৩ মাস থাকবে। অর্থাৎ ডিসেম্বরে শীতের মধ্যেও ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে বলে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর মৌসুম মে–সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, এই ৫ মাস। তবে গত বছর অক্টোবর মাসেও ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল। এ বছর ডেঙ্গুর মৌসুম আরও প্রলম্বিত হচ্ছে।
বিশ্বে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ব্রাজিলে (১৫ লাখ ২০ হাজার), মারা গেছেন ৯২০ জন। বাংলাদেশে মৃত্যু হয়েছে ১২০০ উপর, মৃত্যু হার ০.৫%। অর্থাৎ দুই শ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে তাঁদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হচ্ছে।
ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশার নাম ‘এডিস এজিপ্টি’। সাধারণ মানুষ একে ‘ডেঙ্গু মশা‘ নামে চেনে। ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী এডিস মশা কামড়ালে স্থানটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফুলে যায় এবং চুলকায়। একসময় বলা হতো ডেঙ্গু মশা শুধুমাত্র দিনের বেলা কামড়ায়। কিন্তু এডিস মশা তাদের চরিত্র বদলিয়েছে। এখন দিন রাত সব সময়ই কামড়ায়। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা খালি চোখে দেখে শনাক্ত করা সম্ভব। মশাটি মাঝারি আকারের হয়ে থাকে। এর গায়ে ও পায়ে সাদা কালো ডোরাকাটা দাগ থাকে। আর্মিগিয়ার নামে একটি মশার পেটেও একই ধরণের ডোরাকাটা দাগ রয়েছে। তবে শুধুমাত্র এডিস মশার পায়েই ডোরাকাটা দাগ থাকে।
এডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হবে, বিষয়টি তেমন নয়। যে এডিস মশাটি ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহন করছে, সেটি কামড়ালে ডেঙ্গু হতে পারে। যেকোনও মশার মতই এডিস মশাও সাধারণত একাধিক ব্যক্তিকে কামড়ায়। এডিস মশা সাধারণত শুকনো ছায়াযুক্ত স্থানে থাকে। এটি যে কোনো জমে থাকা স্থির পানিতে ডিম পাড়ে। পানি পরিষ্কার কিংবা নোংরা–সেটা বিষয় নয়। এক সময় বলা হতো এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে বংশ বিস্তার করে। তবে সামপ্রতিক গবেষণায় সেই বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন দেখা গেছে। পুরানো টায়ার, ড্রাম, বালতি, ফেলে দেয়া বোতল বা পাত্র, নারিকেলের খোল, চৌবাচ্চা, নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা পানি, ফুলের টব, ইটের গর্ত এমন স্থানে এডিস মশা উৎপন্ন হয়। ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত দুই ধরণের হয়ে থাকে ক্লাসিকাল এবং হেমোরেজিক। ক্লাসিকাল ডেঙ্গু সাধারণত ৫–৭ দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে হেমোরেজিক ডেঙ্গু হলো বিপজ্জনক। সাধারণত জ্বর সারার পরপরই অনেকের প্লাটিলেট এবং রক্তচাপ কমতে শুরু করে। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে জ্বরের ৩ দিনের মধ্যে প্লাটিলেট কমতে দেখা যায়। যদিও প্লাটিলেট একবার কমার পর সেটি ৪৮–৭২ ঘণ্টার মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করে। তবে কেউ যদি ডেঙ্গু হেমোরেজিক শক সিন্ড্রোমে চলে যায় তাহলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং মৃত্যুবরণ করে।
তবে এই ধরনের রোগী সেরে উঠতেও দীর্ঘ সময় লাগে। কারো যদি ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ থাকে সেক্ষেত্রে উচিত হবে দ্রুত ডেঙ্গু টেস্ট করানো। সাধারণত রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত কি না তা শনাক্ত করা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় অর্থাৎ জ্বর হওয়ার বা ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেয়ার তিন দিনের মধ্যে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করাতে বলেন। এই পরীক্ষা ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার বা লক্ষণ দেখা দেয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে করতে হয়। এই সময়ের মধ্যে এটি ডেঙ্গুর সংক্রমণ শনাক্ত করতে পারে। এছাড়া রক্তের পরীক্ষা সিবিসি ও ইএসআর ডেঙ্গু পজিটিভ হওয়ার একদিন পর পর করতে হয়। কারণ প্লাটিলেটের এবং ডইঈ বা শ্বেত রক্ত কণিকার কম–বেশি দেখে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনুমান করা হয়। রোগীর ডেঙ্গু থেকে উন্নতি হচ্ছে কিনা এই টেস্ট করে ধারণা পাওয়া যায়। আমাদের শরীরে থাকা তিন ধরনের রক্তকণিকার একটি হলো প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা। প্লাটিলেটের মূল কাজ রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করা। শরীরের কোথাও কেটে গেলে দ্রুত রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডেঙ্গু রোগে প্লাটিলেট কমে যায়। শরীরে প্লাটিলেটের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা আছে, সাধারণত প্রতি মিলি লিটার রক্তে দেড় লাখ থেকে চার লাখ। এটি ১০–১৫ হাজারে নেমে গেলে রোগীর অবস্থা আশংকাজনক হয়ে যায়।
ডেঙ্গু রোগীকে স্বাভাবিক সব ধরণের নরম খাবার খেতে পরামর্শ দেয়া হয়। সেই সাথে ফলের রস, স্যুপ, ডাবের পানি, ওরস্যালাইন বা অন্যান্য তরল খাবার প্রচুর পরিমাণে দেয়া যেতে পারে। এগুলো শরীরের পানি এবং ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। এই রোগ শুধু মশার মাধ্যমেই ছড়ায়। ডেঙ্গুর লক্ষণসমূহ হলো শরীরে ব্যথা বিশেষত জয়েন্টে ব্যথা, পেশিতে ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা। শরীরে লালচে র্যাশ, পাতলা পায়খানা, পেটে ব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, কাশি, ক্ষুধা মন্দা,অস্বাভাবিক দুর্বলতা, ক্লান্তি, শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ বিশেষ করে মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ, কালো রঙের পায়খানা, মাসিকে অতিরিক্ত রক্তপাত। রক্তচাপ কমে যাওয়া, পালস রেট বেড়ে যাওয়া। তবে যেহেতু বর্তমানে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি এবং ডেঙ্গুর ধরন বার বার পরিবর্তন হচ্ছে। তাই কারো জ্বর হলে ডেঙ্গুর লক্ষণের অপেক্ষা না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার, জলাবদ্ধতা নিরসন, মশক নিধন, সড়ক বাতি জ্বালানো ও সড়ক সংস্কার–এগুলো হলো একটি সিটি কর্পোরেশনের মূল কাজ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর কোনওটিই সঠিক ও পরিপূর্ণভাবে সম্পাদন করতে পারে না। অথচ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২০২৩–২৪ অর্থ বছরের বাজেটের (১,৮৮৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা) মধ্যে পরিচালন ব্যয় (বেতন, ভাতা ও পারিশ্রমিক খাতে) প্রায় এক পঞ্চাংশ (৩১০ কোটি টাকা)। এতো বিপুল ব্যয়ের পরেও মশা নিধনসহ মূল কাজগুলো করতে না পারা ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নয়। বর্তমানে মশার উপদ্রবে চট্টগ্রাম বাসীর অবস্থা শোচনীয়। প্রতিদিন মশা বাহিত রোগ বিশেষ করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। অথচ মশক নিধন কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৫ কোটি টাকা (যদিও এই টাকায় মশক নিধন করা অসম্ভব)। অভিযোগ আছে কোনও কোনও এলাকায় মাসের পর মাস ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা হয় না।
তাই ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে নিজে সতর্ক হয়ে ঘরের চারিপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যতটা সম্ভব হাত ও পা ঢেকে রাখতে হবে। দিনে রাতে মশারি ব্যবহার, দরজা জানালায় মশারোধী নেট, সেই সাথে মশা নিরোধক ক্রিম, স্প্রে, অ্যারোসল, প্যাচ ব্যান্ড, কয়েল, ধুপ, ম্যাট, ব্যাট ইত্যাদি ব্যবহার করে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিজের প্রতি নিজে যত্নশীল হয়ে সতর্কতা অবলম্বন না করলে সিটি কর্পোরেশন বা অন্য কেউ আপনাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।