বর্তমান বাংলাদেশের এক অন্যতম আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। সামপ্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে তার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে মশাবাহী রোগসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী হলো ডেঙ্গু। বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। সে সময় ৫ হাজার ৫০০ মানুষ আক্রান্ত হয় ডেঙ্গুতে। এরপর থেকে প্রতি বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছিল ২০১৯ সালে। বছরটিতে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ১৭৯ জন।
গত ৩০ মে দৈনিক আজাদীতে ‘চট্টগ্রামেও বাড়ছে ডেঙ্গু, বর্ষার আগে প্রকোপ বাড়ায় চিন্তিত স্বাস্থ্য বিভাগ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এবছর অনেকটা আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকায়। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এ নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গতবারের তুলনায় এবার আক্রান্তের সংখ্যা ৫ গুণ বেশি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক। রাজধানী ঢাকা ও কক্সবাজার নিয়ে সতর্কবার্তা জারি করলেও পিছিয়ে নেই চট্টগ্রামও। তুলনামূলক কম হলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে এ অঞ্চলে। এক মাসের ব্যবধানেই আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। গত এপ্রিল মাসে মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৮ জন। আর ক’দিন বাকি থাকতেই চলতি মে মাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫ জনে। মাসের বাকি কয়েকদিনে এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। হিসেবে চলতি মে মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের এ সংখ্যা গত মাসের (এপ্রিল) তুলনায় প্রায় তিনগুণ। তবে মার্চ মাসের আক্রান্তের তুলনায় চলতি মাসের আক্রান্তের সংখ্যা চারগুণ বেশি। মার্চ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১২ জন রোগী শনাক্ত হয় চট্টগ্রামে।
প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরা হয়েছে। তাঁরা বলছেন, মূলত বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। কিন্তু এবার পুরোদমে বর্ষা না নামতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত স্বাস্থ্য বিভাগও। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে বলে মনে করেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। তিনি বলেন, কিছুদিন বেশ গরম পড়লেও ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামে। আর থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন পাত্রে (জায়গায়) পানি জমে মশার লার্ভার সৃষ্টি হচ্ছে। যেখানে এডিশ মশার প্রজনন (বংশ বিস্তার) ঘটছে। মূলত এ কারণেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হচ্ছে মশার লার্ভা ধ্বংস করা, এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ করা। মোটকথা মশক নিধন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা। আর মশা নিধনের এ কাজ স্বাস্থ্য বিভাগের নয়। সিটি কর্পোরেশন বিষয়টি দেখবে। স্বাস্থ্য বিভাগ মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। অভিন্ন মত পোষণ করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিধন কার্যক্রমে জোর দিতে বলেছেন চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, মশা নিধন কার্যক্রমে সিটি কর্পোরেশনকে এখনই ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো ঢাকা ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মতো পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
কীটতত্ত্ববিদদের মতে, নির্মাণ প্রকল্প এলাকায় মশা উৎপাদন ক্ষেত্র বিনাশ করা সম্ভব হলে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। তাঁরা বলেন, সাধারণত মশক নিধন কার্যক্রমের স্থবিরতা, গাইডলাইনের অভাব এবং মানুষের অসচেতনতাই ডেঙ্গুর প্রকোপের জন্য দায়ী। হঠাৎ থেমে থেমে স্বল্পমেয়াদি বৃষ্টিতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা খুব বেশি মাত্রায় প্রজনন সক্ষমতা পায়। ফলে এডিস মশার বিস্তারও ঘটে বেশি। উৎস বন্ধ না করতে পারলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে। সরকার এবং জনগণের সমন্বিত উদ্যোগই পারে এ মহামারি থেকে আমাদের সুরক্ষিত রাখতে। পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা, মশার জৈবিক নিয়ন্ত্রণ, মশক নিধন কীটনাশক প্রয়োগ এবং গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
তাঁদের মতে, প্রাচীন এই রোগের প্রধান প্রতিষেধকই সচেতনতা ও পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা। বাড়ির আশপাশে পানি জমে এমন জায়গা, বদ্ধ জলাশয় পরিষ্কার রাখতে হবে। ফ্রিজ ও এসির পানি যেন না জমে থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।