পত্রপত্রিকায় আমরা দেখতে পাই, হঠাৎ করেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। বিশেষ করে বন্যা কবলিত এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়ানক আকার ধারণ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ভাঙা রাস্তা ঘাট, ডোবা ব্যাম্ব ষ্ট্রাম্ফ, লিফ এক্সইল, গাছের ছিদ্র প্রভৃতি প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রগুলোর বিস্তৃতি যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, একই তালে এডিস মশার ট্রান্সমিশন হচ্ছেও সমান তালে। তাই বন্যা কবলিত জেলাগুলোতে মানুষের জন্য এক অকল্পনীয় ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে। এ বছরের ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বিশ্লেষণে চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশন ছাড়া) সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যাও আশঙ্কাজনক। আবার ডেঙ্গুর চিকিৎসাও এক ভয়ানক অর্থনীতির বিপর্যয় বয়ে আনবে। সব মিলিয়ে এক অশনি সংকেত চলছে দক্ষিণ অঞ্চলসহ সারাদেশে। এখন এই চরম দুর্ভোগ মোকাবেলায় আমাদের কী করণীয়–তা নির্ধারণ করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আক্রান্তদের ৪২ দশমিক ৯৫ শতাংশ ঢাকা মহানগর ও ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ ঢাকার বাইরের। মৃতদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ঢাকা ও ৩০ শতাংশ ঢাকার বাইরের। আক্রান্তদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ নারী ও ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ পুরুষ। মৃতদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ নারী ও ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ।
সাধারণত বর্ষা–পরবর্তী সময়, অর্থাৎ আগস্ট থেকে অক্টোবরকে ডেঙ্গুর ‘পিক সিজন’ বলা হয়। বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, এডিস মশার ঘনত্ব অনুযায়ী চলতি মাস সেপ্টেম্বরকে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ প্রকোপ থাকতে পারে বলে মনে করছেন কীটত্বত্তবিদ ও সংক্রমণ বিশেষজ্ঞরা। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে গত এক দশকে সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর ‘পিক সিজন’ হয় পাঁচবার। অক্টোবরে তিনবার, নভেম্বরে ও আগস্টে একবার করে পিক সিজন হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটা সময় ধারণা করা হতো, বর্ষাকাল মানেই হলো ডেঙ্গুর মৌসুম। কিন্তু এখন সে বিশ্বাস পাল্টানোর সময় এসেছে। কারণ, এখন শুধু বর্ষা নয়, শীত–গ্রীষ্মেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার পত্রিকান্তরে বলেছেন, অক্টোবরে কী হবে, সেটা বলতে পারছি না। তবে আমাদের ফোরকাস্টিং মডেল (পূর্বাভাস) বলছে– সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ থাকবে। এমনকি পিক সিজনও হতে পারে। তিনি বলেন, গত আগস্টের জরিপে ঢাকায় গড় ব্রুটো ইনডেক্স ছিল ২০ শতাংশের ওপরে। সর্বোচ্চ ছিল ৭০ শতাংশ। ঢাকার বাইরে সাভার এলাকায় ২০ শতাংশের ওপরে ব্রুটো ইনডেক্স পেয়েছি। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা ও বরিশালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েছে; অর্থাৎ যে এলাকায় এডিস মশা ও রোগী আছে, সেখানে ডেঙ্গু রোগী বাড়বে।
মশাবাহিত এই রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী পদক্ষেপ হয়তো নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে থাকতে পারে সচেতনতা তৈরিতে (অ্যাওয়ারনেস) ক্যাম্পেইন, মশার বংশবিস্তারের স্থান নির্মূল ও লার্ভা নিধন। তাছাড়া বয়স ও এলাকা ভিত্তিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী এবং এতে মৃত্যুর তথ্য শ্রেণিবিন্যাস করা দরকার । দেশজুড়ে ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য সব হাসপাতালে আগে থেকেই আলাদা ইউনিট করা হয়েছে।
এরপরও, ডেঙ্গু মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গুরুতর এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি। বিশেষজ্ঞগণ ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি সমন্বিত জাতীয় কৌশলের কথা ভাবতে পারেন। যা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি জোরালো কমিউনিটিকেন্দ্রিক ডেঙ্গু নজরদারির ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর জোর দেওয়া জরুরি, যার আওতায় স্বল্প সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা যাবে। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার বংশবিস্তারের স্থান নির্মূলে কমিউনিটির নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণও ডেঙ্গু সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে পারে। মোট কথা, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে এখন প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে নিয়ে বিভিন্ন খাতের সমন্বয়ে একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা।