ডুলাহাজারার রিজার্ভ পাড়া খোদ বনবিভাগের ‘মাথা ব্যথা’র কারণ

সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বনদস্যু ও সন্ত্রাসীদের রাজত্ব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব

চকরিয়া প্রতিনিধি | সোমবার , ৮ মে, ২০২৩ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের ডুলাহাজারা বনবিটের অধীন পূর্ব ডুমখালীর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় ৫০ একর বনভূমিতে কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে অন্তত পাঁচ শতাধিক অবৈধ বসতি। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা হওয়ায় এখানে দেদারসে উজাড় হচ্ছে বনের গাছপালা। প্রতিনিয়ত কেটে নেওয়া হচ্ছে বনভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী মাদার ট্রি (গর্জন), আকাশমণিসহ হরেক প্রজাতির গাছ।

শুধু তাই নয়, পূর্ব ডুমখালীর এই এলাকাটি বর্তমানে রিজার্ভ পাড়া হিসেবেও পরিচিত। উঁচুনিচু ও টিলা শ্রেণীর পাহাড়বেষ্টিত সেই রিজার্ভ পাড়াটি বলতে গেলে সবার কাছেই এখন আতঙ্কের জনপদ। এখানে মোড়ে মোড়ে আস্তানা গেঁড়েছে দুর্ধর্ষ ডাকাত ও বনদস্যুর দল। এখানে অবস্থানরত অপরাধী দলের সদস্য সংখ্যা প্রায় শতাধিক। তন্মধ্যে ৪০ জন বনদস্যুর একেক জনের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন করেও মামলা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। সেই পরোয়ানা বছরের পর বছর ধরে থানায় পড়ে রয়েছে। নিরীহদের অভিযোগআইনশৃঙ্খলা বাহিনী একেবারে নীরব ভূমিকাই পালন করছে। এ অপরাধীদের ধরতে পুলিশের কোনও ধরনের তৎপরতাও নেই। এই অবস্থায় ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পুরো রিজার্ভ পাড়াটি খোদ বনবিভাগের কাছে ‘মাথা ব্যথা’র কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বনবিভাগ ও স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য মতে, ২০২২ সালের ২৩ মে রাতে এই রিজার্ভ পাড়ায় অপরাধকর্মের নিয়ন্ত্রণ বা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিবদমান সশস্ত্র দুই বাহিনীর (আমির হোসেন ও আবদুর রহমান বাহিনী) মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ সময় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয় বাহিনীপ্রধান আমির হোসেন ডাকাতকে। এর পর আইনশৃক্সখলা বাহিনী

কিছুটা তৎপর হলে গ্রেপ্তার হন আবদুর রহমান ও তার সাঙ্গপাঙ্গোরা। এতে অল্প সময়ের জন্য অপরাধকর্ম কমে আসলেও পরবর্তীতে সেই অপরাধের হাল ধরে আহমদ হোছন, কলিম উল্লাহ, মিন্টু, নুরুল ইসলাম, হেলাল, মনসুর আলম, শাহ আলম, কেশ্যা বারেক, আবছার, রমিজ সহ ৪০ জনের সিন্ডিকেট।

স্থানীয় একটি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক মাদরাসা শিক্ষক দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘রিজার্ভ পাড়াটি এখন পুরোপুরি বনদস্যুসন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণেই চলে গেছে। বলতে গেলে এখানে আইনশৃক্সখলা বাহিনীর কোনও ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব বনদস্যুসন্ত্রাসী প্রতিনিয়ত গাছ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।’

ওই শিক্ষক বলেন, বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ এবং ডুলাহাজারা বনবিট কার্যালয়টি রিজার্ভ পাড়ার কয়েকশ গজের দূরত্বে অবস্থিত। কিন্তু বনবিভাগের কর্মকর্তাকর্মচারীদের চোখের সামনেই প্রতিনিয়ত কাটা হচ্ছে গাছ। এর পরেও বনবিভাগকে নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে থাকা ছাড়া কোনও উপায়ান্তর নেই। কারণ এখানে ‘পা ভাঙ্গা মুরগি যেমন শিয়ালের কাছে অসহায়’ তেমনি অবস্থায় রয়েছে বনবিভাগ। সর্বশেষ গত শনিবার বিকেলে সংঘটিত ঘটনাই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে যোগ করেন ওই শিক্ষক।

রিজার্ভ পাড়ার নিরীহ বাসিন্দারা জানান, প্রতিনিয়তই বনদস্যুসন্ত্রাসীদের ভয়আতঙ্কে তটস্থ থাকতে হয় তাদের। গত শনিবারের ঘটনার পর থেকে রিজার্ভ পাড়ার নিরীহ লোকজন ঘরের বাইরেও যাচ্ছে না জরুরি প্রয়োজন ছাড়া। যারা বের হচ্ছে তারা রীতিমতো কৈফিয়তের শিকার হচ্ছে বনদস্যুসন্ত্রাসীদের। এতে কার্যত স্বাভাবিকভাবে চলাফেরাও বন্ধ হয়ে গেছে।

চোখের পানি মুছতে মুছতে ভুক্তভোগী একটি পরিবারের কর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘সাগরের ভাঙনে বসতভিটে হারিয়ে ১৫ বছর আগে মহেশখালীর মাতারবাড়ি এলাকা থেকে এসে পূর্ব ডুমখালী রিজার্ভ পাড়ায় বসতি স্থাপন করেছিলাম। এর পর মনে করেছিলাম এখানে শান্তিতে বসবাস করতে পারবো। কিন্তু গত বছরের মে মাসে ডাকাত আমির হোসেন ও আবদুর রহমানের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ব্যাপক সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে নিহত হয় আমির হোসেন। এর পর আমির হোসেনের সাঙ্গপাঙ্গোদের অত্যাচারনির্যাতন বেড়ে যায় পুরো পাড়ায়।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার পরিবারে স্ত্রী ছাড়াও দুই কন্যা সন্তান ছিল স্কুল পড়ুয়া। সেই দুই কন্যাকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করতো বনদস্যুসন্ত্রাসী দলের সদস্যরা। শেষ পর্যন্ত সেই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি। কোথাও কারো কাছে অভিযোগও করতে পারিনি, মেয়ের ভবিষ্যত মাথায় রেখে। এই ধরনের অসংখ্য পরিবার আমার মতো ভুক্তভোগী হয়েছে। যার কারণে তিনটি পরিবারের ছেড়ে যাওয়া বসতবাড়িগুলো এখন অপরাধীদের আস্তানা।

বর্তমান ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর বলেন, ‘শান্ত ডুলাহাজারাবাসীর কাছে এখন আতঙ্কের জনপদ পূর্ব ডুমখালী রিজার্ভ পাড়া। সংরক্ষিত বনভূমি হলেও ওই এলাকাটি এখন পুরোপুরি সন্ত্রাসী ও বনদস্যুদের অভয়ারণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এ নিয়ে ইতোপূর্বে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং পুলিশের কাছে বার বার বলা হলেও কোনও কাজ হয়নি। সম্প্রতি রিজার্ভ পাড়ার শিশু, কিশোরদের জন্য আগে থেকে বিদ্যমান বিশাল খেলার মাঠটিও দখলে নিয়ে প্লট আকারে বিক্রির পর সেখানে অবৈধ বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে।’

চেয়ারম্যান আদর বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে র‌্যাবের হস্তক্ষেপ চাইলে ছদ্মবেশে তিনজন দুর্ধর্ষ ডাকাতবনদস্যুকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু পুলিশ কোনভাবেই সেখানে অভিযান চালাতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। যদিওবা রিজার্ভ পাড়ার শতাধিক সন্ত্রাসীবনদস্যুর বিরুদ্ধে জারিকৃত গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কাগজ থানায় পড়ে রয়েছে। তবে এই রিজার্ভপাড়াকে পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে যৌথবাহিনীর পরিকল্পিত সাঁড়াশি অভিযান জরুরি।

সর্বশেষ শনিবার সংঘটিত ঘটনায় ডুলাহাজারা বনবিট কর্মকর্তা অবনী কুমার রায় বাদী হয়ে চকরিয়া থানায় গতকাল রবিবার একটি মামলা রুজু করেছেন। মামলায় এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে ১০ জনকে। এছাড়াও অজ্ঞাত আসামি দেখানো হয়েছে ১২ জনকে।

মামলার বাদী অবনী কুমার বলেন, ‘গত এক বছরে বনদস্যুসন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ৩০টির মতো মামলা রুজু করা হয়েছে। এসব মামলায় ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা গেলেও শতাধিক বনদস্যুসন্ত্রাসী পলাতক অবস্থায় রয়েছে।’

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘উত্তর বনবিভাগের পাঁচটি বিটের মধ্যে একমাত্র ডুলাহাজারা বনবিটের পূর্ব ডুমখালীর রিজার্ভ পাড়াটি নিয়েই যত মাথা ব্যথা আমাদের। বনভূমি দখল বা গাছ কাটার খবর পেয়ে অকুস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করলেই হামলে পড়ছে বনদস্যুসন্ত্রাসীর দল। এর পরও বনবিভাগের কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছে বনভূমি ও গাছপালা রক্ষায়।’

এ ব্যাপারে চকরিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আবদুল জব্বার রিজার্ভ পাড়া অপরাধীদের আস্তানা হিসেবে গড়ে ওঠার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘বনবিভাগের পক্ষ থেকে যখনই লিখিত অভিযোগ করা হয় বা সহায়তা চাওয়া হয় তা দেওয়া হয়ে থাকে। পরোয়ানাভুক্ত আসামি থাকলে তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান জোরদার করবে।

চকরিয়ার আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে ডুলাহাজারার রিজার্ভ পাড়ার বনদস্যুসন্ত্রাসীরা। এমন ইঙ্গিত করে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘অচিরেই এই রিজার্ভপাড়া অপরাধীমুক্ত করতে আইনশৃক্সখলা বাহিনীর প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসহ্য তাপদাহে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ
পরবর্তী নিবন্ধপানির জন্য নগরবাসীর বাড়তি ব্যয়, ভোগান্তি