চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে জাপানে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। টোকিওর স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার দুপুর ২টা ৫ মিনিটে তিনি জাপানের নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান বলে তার দপ্তর থেকে জানানো হয়। এর আগে মঙ্গলবার রাত সোয়া ২টার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে বহনকারী উড়োজাহাজ ঢাকা ছেড়ে যায়। প্রধান উপদেষ্টা এই সফরে ৩০তম নিক্কেই ফোরামে যোগ দেবেন এবং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে বৈঠক করবেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, সফরে বিনিয়োগ, জ্বালানি ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতার সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা। খবর বাসস ও বিডিনিউজের।
বাজেট সহায়তা এবং জয়দেবপুর–ঈশ্বরদী রেলপথকে ডুয়েল–গেজ ডাবল–ট্র্যাকে উন্নীত করার বিষয়ে নোট বিনিময় হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। সফরসূচি অনুযায়ী, টোকিওতে পৌঁছানোর পর প্রধান উপদেষ্টা বুধবার বিকাল ৫টায় জাপান–বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফ্রেন্ডশিপ লীগের (জেবিপিএফএল) প্রেসিডেন্ট তারো আসোর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে আগামী বছরের জুনের মধ্যে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম সামনে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বন্ধু তারো আসো, যিনি জেবিপিএফএল–এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন, অধ্যাপক ইউনূসকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে অগ্রসর করার জন্য ধন্যবাদ জানান এবং একটি মসৃণ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তিনটি প্রধান বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে– সংস্কার, খুনিদের বিচার এবং সাধারণ নির্বাচন আয়োজন।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং ঋণ পরিশোধে সরকার উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, পূর্ববর্তী সরকার আমাদের দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে, যার ফলে তরুণ সমাজের মধ্যে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়েছে। সেই তরুণরাই আমাকে এই বিশৃঙ্খলা দূর করার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তিনি বলেন, গত দশ মাসে জাপান আমাদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে। আমি জাপানকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এক অর্থে, এটি একটি কৃতজ্ঞতা সফর। অধ্যাপক ইউনূস তারো আসোকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান, যাতে তিনি নিজের চোখে পরিবর্তনগুলো দেখতে পারেন।
সাক্ষাতের সময় তারো আসোর সঙ্গে থাকা কয়েকজন জাপানি সংসদ সদস্য বলেন, ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (ইপিএ) স্বাক্ষর বাংলাদেশে বৃহত্তর পরিসরে জাপানি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। বাংলাদেশ আগামী আগস্টের মধ্যে আলোচনার কাজ শেষ করে সেপ্টেম্বর মাসে ইপিএ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রত্যাশা করছে। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে, জাপান হবে বাংলাদেশে ইপিএ স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশ।
প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতি সম্পর্কে জাপানি সংসদ সদস্যদের অবহিত করেন এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এজেন্ডা বাস্তবায়নে তাদের সহায়তা কামনা করেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট অন্যান্য শরণার্থী সংকটের থেকে ভিন্ন, কারণ তারা অন্য কোনো দেশে যাওয়ার জন্য অনুনয় করছেন না, বরং নিজ দেশে ফেরার দাবি করছেন।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ।
তারো আসোর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা যোগ দেন নিপ্পন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইয়োহেই সাসাকাওয়ার নৈশভোজে। এরপর জাপানের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তার মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। নিক্কেই ফোরামের আগে আজ বৃহস্পতিবার নিক্কেই ইনকরপোরেটেডের ঊর্ধ্বতন নির্বাহীরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এরপর ৩০তম নিক্কেই ফোরামের উদ্বোধনী অধিবেশনে মূল বক্তৃতা দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে তিনি ‘অশান্ত বিশ্বে এশিয়ার চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে কথা বলবেন।
লাওস ও পালাউয়ের প্রেসিডেন্ট, জাপান ও কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরের উপ–প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, নীতি বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা ফোরামে অংশগ্রহণ করবেন। এদিন প্রধান উপদেষ্টা টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাসের আয়োজনে মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সেমিনারে যোগ দেবেন। সেখানে তিনি জাপানের দক্ষ কর্মীবাহিনীর চাহিদা পূরণে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনা তুলে ধরে বিশেষ ভাষণ দেবেন।
অধ্যাপক ইউনূস জাপানের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন, যাদের মধ্যে জাইকার প্রেসিডেন্ট তানাকা আকিহিকোও থাকবেন। সেখানে বাংলাদেশে চলমান উন্নয়ন সহযোগিতা এবং জাইকার অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো নিয়ে পর্যালোচনা হবে। তিনি জাপানের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম– নিক্কেই, এনএইচকে, আসাহি শিম্বুন, আসাহি টিভি ও নিপ্পন টিভিকে সাক্ষাৎকার দেবেন।
২৯ মে সন্ধ্যায় তিনি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট বক্তাদের সম্মানে নিক্কেই ফোরাম আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দেবেন। পরদিন সকালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা এবং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে। টোকিওতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ওই বৈঠকের আগে লাল গালিচা সংবর্ধনা ও গার্ড অব অনার দেওয়া হবে অধ্যাপক ইউনূসকে।
বৈঠকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি সহযোগিতা, মানবসম্পদ ও রোহিঙ্গা সংকটসহ কৌশলগত বিষয় বিস্তৃত আলোচনা হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তরফে জানানো হয়েছে। এদিন ড. ইউনূস দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়ে জেট্রোর প্রেসিডেন্ট কিমুরা ফুকুনারির সঙ্গে বৈঠক করবেন। তিনি জাপানি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের পাশাপাশি ‘বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনারে’ যোগ দেবেন। সেখানে তিনি বিশ্বব্যাপী সিইও, সামাজিক ব্যবসা সার্কেলের সদস্য ও উভয় দেশের তরুণ পেশাদারদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
সামাজিক উদ্ভাবন ও বৈশ্বিক উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সোকা বিশ্ববিদ্যালয় বিকালে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেবে। সেখানে তিনি দর্শক–শ্রোতাদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত একটি কমিউনিটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। সেখানে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলবেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ হাউসে জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আয়োজিত নৈশভোজে অংশ নেবেন।
প্রধান উপদেষ্টা শনিবার সকালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে টোকিও ত্যাগ করবেন এবং সিঙ্গাপুর হয়ে ওই রাতেই তার ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।