কয়েকদিন আগে একজন রাগান্বিত এবং অনেকটা হতাশ এক অভিভাবক আমাকে বললেন, ‘পড়ালেখার নামে তামাশা শুরু হয়েছে, মেয়ের ক্লাসে ডিমভাজা করা আর কী করে ঘরদোর পরিস্কার রাখতে হয় শেখানো হচ্ছে। এগুলো কী শেখানোর জিনিস? শেষ পর্যন্ত ডিমভাজা শেখানোর জন্য মেয়েকে স্কুলে পাঠাবো?’
স্কুলে ডিমভাজা শেখালে ক্ষতি তো নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে খেতে হয়। প্রতিদিন পৃথিবীর সব অঞ্চলে প্রতিটি মুহূর্তে রান্না চলছে। এই অপরিহার্য অবশ্যম্ভাবী বিষয়টি স্কুলে শেখালে আপত্তি কেন? জানতে চাইলাম সেই অভিভাবকটির কাছে।
তিনি আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন, ‘আরে ভাই যে জিনিসটা আমি অনায়াসে বাড়িতে বসে শিখতে পারছি, সেটার জন্য কেন স্কুলের মূল্যবান সময় নষ্ট করব? স্কুলে গণিত, ইতিহাস, বিজ্ঞান এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শিখবে।’
‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয় শেখার জন্য রান্নার মতো অপরিহার্য বিষয়কে এরকম অগুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন অনেক অভিভাবক। স্কুলে রান্নাকে পড়ালেখার বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো যুক্তি তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। নতুন কোনো কিছুকে গ্রহণ করতে সমাজ চিরকাল দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছে, বিরোধিতা করেছে। নতুন পাঠ্যক্রমের আওতায় রান্না কীভাবে শেখানো হচ্ছে সেটা আমি দেখিনি। উত্তেজনার বশে অভিভাবকও সেদিন বলতে পারেননি। কিন্তু ডিমভাজা শেখানোর ক্লাসে একটি পিকনিকের আবহ তৈরি হয়েছে ব্যাপারটা ভাবতেই পুলকিত হয়েছি। নিজের জীবনে প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিকের ক্লাসে শিক্ষকের মার খাওয়ার ভয়ে সদা তটস্ত থাকা এবং বন্দীদশার দিনগুলোর সঙ্গে ডিমভাজার ক্লাসকে একবার মিলিয়ে দেখলাম। মনে হলো নতুনটাই ভালো। ক্লাসতো এরকম উৎসবের মতো হওয়া উচিত। আমি তাকে বললাম, আনন্দ করতে করতে ওরা কিছু শিখবে, তাতে অসুবিধা কী? ক্লাসে ওরা পিকনিকের আমেজ পাবে। উনি ভাবলেন আমি তামাশা করছি। খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে আমাকে বললেন, ভাইজান পিকনিক বছরে একবার মজা। প্রতিদিন ক্লাসে এসব করলে পোলাপাইনের পড়ালেখা গোল্লায় যাবে। হতাশ এই অভিভাবকের মনে আশা দিতে, তার দুশ্চিন্তা দূর করতে আমি নতুন পদ্ধতির পড়ালেখার পক্ষে নিজের স্বপ্ন মিশিয়ে আলাপ চালিয়ে গেলাম। বললাম, দেখুন আপনি যদি আপনার মেয়েকে ঘরে বসে ডিমভাজা করতে শেখান। সে ওই ডিমভাজাটা খেয়ে হজমই করবে। আর কিছু শিখবে না।
কী শিখবে? উনি জানতে চাইলেন।
আমি বললাম, এই যে সবাই মিলেমিশে একটা ব্যাপার শিখছে, সবাই মিলে ক্লাসে বসে খাবে, এর মধ্যে একটা বিরাট শিক্ষা আছে। সে তো সমাজবিচ্ছিন্ন নয়। তার ভেতরে একটা সাম্যবোধ তৈরি হবে।
আমার কথায় তিনি মুচকি হাসলেন। কিন্তু হতাশা গেল না। বললাম, দেখুন তারা শুধু ডিম ভাজা কী করে করতে হয় সেটা শেখেনি। শেখানোর আগে স্যার তাদেরকে ডিমের অনেক বিকল্প শব্দ বলেছেন গল্পের ছলে। কেউ ডিমকে বলে আন্ডা, চট্টগ্রামের ভাষায় এটাকে কেউ কেউ বজা বলে।বাংলা ভাষায় ডিমের অনেক নাম আছে যেমন অণ্ড, বয়দা, বয়জা। ইংরেজিতে egg বলে? এগুলো তারা খুব আগ্রহ নিয়ে শিখেছে। শুধু তা নয়। ঘোড়ার ডিম কীভাবে পয়দা হলো সেই প্রবাদবাক্যও শিখেছে। ডিমভাজার উপকরণ দেখাতে দেখাতে শিক্ষক তাদের ডিম নিয়ে নানা কুসংস্কার, প্রচলিত গল্পও বলেছেন। আমাদের ভাষায় আন্ডা বা ডিম শব্দটির নানা প্রয়োগের উদাহরণও শিখিয়েছেন তাদের। যেমন, ‘তুই তো পরীক্ষায় একটা আন্ডা পাবি।’
তাই নাকি? এরকমই হবে? অভিভাবক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
আমি বললাম, এরকমই তো হওয়ার কথা। এই ডিমভাজার ক্লাসে আরো অনেক কাণ্ড হয়েছে। শিক্ষক ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, ডিম পাড়ে কারা? ছাত্ররা সবাই একবাক্যে বলল, পাখিরা।
শিক্ষক বললেন, শুধু পাখিরা? তোমরা বাড়িতে মাছের ডিম কখনো খাওনি? শুধু মুরগি হাঁসের ডিম খেয়েছ? তাই তো! এই কথাটা তাদের মনে আসেনি। শিক্ষক এর পর তাদের কয়েকটা ছবি দেখালেন, সাপের ডিমের ছবি। সাগরসৈকতের কাছে কচ্ছপের ডিম। কুমিরের ডিম। একটা পাখির বাসায় দুটো ডিমের ছবিও দেখালেন তিনি। ডিমভাজি করার আগে ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের চারটি দলে ভাগ করলেন। একদলকে বললেন, সবাই মিলে একটা পাখির বাসা আঁকতে। আরেক দলকে বললেন, ডিমের যত বিকল্প শব্দ আছে সেগুলোর প্রত্যেকটা দিয়ে বাক্য রচনা করতে। কোনো দলকে বললেন, ডিম নিয়ে একটা গল্প লিখতে। আরেক দলকে বললেন, ডিমের বিভিন্ন অংশের নাম লিখতে। ওদের লেখালেখি আর ছবি আঁকা শেষ হলে সবাইকে দেখানো হলো, পড়ানো হলো। ডিমভাজিও শেখানো হলো। সবাই মিলে ডিমভাজি খেলো ক্লাসে। তারপর একজন নতুন শিক্ষক এলেন। তিনি একজন পুষ্টিবিদ। ডিমভাজির ক্লাসের জন্য তাকে অনুরোধ করে আনানো হয়েছে। তিনি ছোটদের জানালেন নতুন নতুন তথ্য। এই যে সবাই মিলে ডিমভাজিটা খেলো, তাতে কী লাভ হলো তা তিনি বুঝিয়ে বললেন। পুষ্টিবিদ ডিমের মধ্যে কী কী ভিটামিন থাকে, ডিম খেলে আমাদের কী কী উপকার হয়, প্রতিদিন কেন, কীভাবে ডিম খাবো, সব বুঝিয়ে বললেন। সবাইকে একটা করে কাগজ দিলেন। ওখানে ডিমের সব বৃত্তান্ত সংক্ষেপে লেখা আছে। পুষ্টিবিদ চলে যাওয়ার পর শিক্ষক সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, এই যে ডিম সবাই মিলে খেলাম, আমাদের কী কী উপকার হলো? সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, আমরা অনেক ভিটামিন পেলাম। পুষ্টি পেলাম। শিক্ষক আবার জানতে চাইলেন, আচ্ছা ডিমগুলো যদি আমরা না খেতাম?
ছাত্ররা বলল, আমরা ভিটামিন পেতাম না।
একদম ঠিক। কিন্তু যদি আমরা না খেতাম ডিমগুলোর কী অবস্থা হতো? সেগুলো কী পড়ে থাকত? নিশ্চয় না। এগুলো যদি মুরগির কাছেই থাকত, মুরগি সেগুলোকে তা দিতো। কয়েকদিন পর সেখান থেকে ফুটফুটে ছানা বের হতো। মা সেগুলোকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। এসব কথা বলতে বলতে তিনি মুরগি আর ছানাদের ছবি দেখালেন। এরপর তিনি ক্লাসে একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখালেন। সেখানে দেখা যায় একটা পাখি সুন্দর করে বাসা বানাচ্ছে। সেই বাসায় ডিম পাড়ল। তারপর সেই ডিম থেকে ছানা হলো। একদিন সেই ছানা উড়াল দিল।
একটা ডিমভাজির ক্লাস এভাবে ভাষা, ছবি আঁকা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, রসায়ন, জীববিদ্যার জ্ঞানের নানা শাখার ক্লাস হয়ে উঠতে পারে। হয়ে উঠতে পারে আনন্দ মেলা। কিন্তু তার জন্য চাই শিক্ষকের ব্যাপক প্রস্তুতি। অনেক আগ্রহ।
নতুন পাঠ্যক্রম গত বছর প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এবছর তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে বাস্তবায়িত হবে। আগামী বছরগুলোতে বাকি ক্লাসগুলোতে চালু হবে। আমাদের প্রত্যাশা নতুন পাঠ্যক্রমে আমাদের স্বপ্নের ক্লাসের মতো বাস্তবায়তি হবে। এতে শ্রেণিশিক্ষকের (ক্লাসটিচার) আন্তরিকতা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। তাকে হতে হবে সৎ। কারণ তিনিই ছাত্রদের মূল্যায়ন করবেন। তাকে দিয়ে যেন কোনো ছাত্রের অবমূল্যায়ন না হয়। তিনি যেন স্বজনপ্রীতিতে অন্ধ না হন।তিনি যেন তার কাছে কোচিং করার জন্য ছাত্রদের জোর না করেন। কারণ শ্রেণিশিক্ষকের হাতেই ছাত্রদের মূল্যায়নের ভার এখন। এ বছর যারা নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের এস এস সি বোর্ড পরীক্ষার ৫০ শতাংশ নম্বর শ্রেণি শিক্ষকেরাই দেবেন। তাঁর হাতে যেন ছাত্ররা জিম্মি না হয়ে পড়েন সেটা খেয়াল রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট বোর্ডকেই। শিক্ষক যেন নিজের প্রাইভেট ছাত্রদের বেশি নম্বর (ত্রিভুজ) না দেন, আর যারা তার কাছে পড়েন না তাদের যেন কম নম্বর (বৃত্ত) না দেন সেটা নজরে রাখা খুব জরুরি। যে কোনো মূল্যে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।
বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য ল্যাবরটরির যথাযথ ব্যবহার এবং প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিশ্চিত করতে হবে। বেশিরভাগ স্কুলে ল্যাবরটরি নেই। নতুন পাঠক্রম চালু হওয়ার আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাধ্যতামূলক ল্যাবরেটরি রাখার ব্যবস্থা করাও দরকার। যে কোনো নতুন কিছু চালুর আগে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না করলে, তার অপব্যবহারের সুযোগ বন্ধ না করলে উপকারতো আসবেই না। বরং ক্ষতিই হবে বেশি। এ কথা সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে।
লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক।