যুক্তরাজ্য ভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি দাতা সংস্থা ‘মুনতাদা এইড’র আর্থিক সহায়তায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) হৃদরোগ বিভাগে বিনামূল্যে দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত অর্ধশত শিশুর জন্মগত হৃদপিণ্ডের ত্রুটির চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সংস্থাটি ‘লিটল হার্টস’ নামের প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ১১শ জন্মগত হৃদরোগীর চিকিৎসা দিয়েছে। তবে চট্টগ্রামে এটিই প্রথম। সেই লক্ষ্যে সংস্থাটির চৌকস চিকিৎসক দলের সদস্যরা গত মে মাসে চমেক হাসপাতালে হৃদরোগ বিভাগে দুইশতাধিক রোগীর স্ক্রিনিং করে। এরমধ্যে থেকে গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া পাঁচদিনের বিশেষায়িত ক্যাম্পে অর্ধশত শিশুকে ক্যাথেটাইরেজাইশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের ডিভাইসের মাধ্যমে জন্মগত হার্টের ছিদ্র বন্ধসহ নানা চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত ৩৬ জন জন্মগত হৃদরোগীর চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। আজ বাকি রোগীদের উপস্থিতি সাপেক্ষে চিকিৎসা দেয়া হবে।
জানা গেছে, জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে ট্রান্স ক্যাথেটার কার্ডিয়াক প্রক্রিয়া, যেখানে ওপেন হার্ট সার্জারি ছাড়াই ফেমোরাল ভেইন বা আর্টারি দিয়ে সূক্ষ্ম ক্যাথেটার প্রবেশ করিয়ে হৃদপিণ্ডের জন্মগত ত্রুটি বন্ধ করা হয়। ত্রুটির ধরন অনুযায়ী এএসডি–ভিএসডি ক্লোজার ডিভাইস, পিডিএ অকলুডার, কয়েল বা স্টেন্ট ব্যবহৃত হয়। শিশুর বয়স, ওজন, হৃদপিণ্ডের চাপ পরিবর্তন এবং ইকোকার্ডিওগ্রাফির ফল দেখে উপযুক্ত ডিভাইস নির্বাচন করা হয়। চিকিৎসায় ব্যবহৃত মূল যন্ত্রপাতি হলো ফ্লুরোস্কপি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি, ক্যাথল্যাব সিস্টেম এবং হেমোডাইনামিক মনিটর। জন্মগত হৃদরোগীদের এই চিকিৎসায় এক থেকে তিন লাখ টাকা ব্যয় হলেও পুরো সেবাটিই দেওয়া হচ্ছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। চট্টগ্রামে পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট সংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে এই ধরণের উন্নত চিকিৎসা বন্ধ থাকায় উদ্যোগটিকে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রথম দফায় শতভাগ সফলতা মিললে এই সেবা কার্যক্রম নিয়মিত করার সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছে দাতা সংস্থাটি। জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের বিনামূল্যে ইন্টারভেনশনাল চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মোট দশ সদস্যের একটি বিশেষায়িত টিম কাজ করছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজওয়ানা রিমাসহ একজন অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ, দুইজন আইসিইউ কর্মী এবং পাঁচজন সহায়ক স্টাফ ছাড়াও তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ক্যাম অ্যান্ড সাকুরা স্টেট হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ এরদেম এই চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
মুনতাদা এইডের প্রোগ্রাম ম্যানেজার কবির মিয়া বলেন, মুনতাদা এইড মূলত পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর জটিল হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করে থাকে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে আমরা কাজ করছি। সেখানকার শিশু যার জন্মগতভাবে হার্টে ছিদ্র আছে এবং চিকিৎসা ব্যয়বহুল এরকম শিশুদের জন্মগত হৃদপিণ্ডের ছিদ্র ডিভাইসের মাধ্যমে সারানো হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশে ঢাকার তিনটি হাসপাতালে এই চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে এবার প্রথমবারের সেবা দেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে আমাদের খুলনা বা অন্যান্য বিভাগীয় শহরে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো এই উন্নত শিশু হৃদরোগ চিকিৎসা বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। মূলত হৃদপিণ্ডে এএসডি ও ভিএসডি থাকলে এই ডিভাইস ব্যবহার করে ছিদ্র বন্ধ করা সম্ভব। একেকটি ডিভাইসের দাম সর্বনিম্ন এক হাজার ডলার থেকে তিন হাজার ডলার পর্যন্ত হয়। চিকিৎসাটি ব্যয়বহুল হওয়ায় বেশিরভাগ গরিব পরিবার পিছিয়ে পড়েছে। এই সেবা চালু রাখলে চট্টগ্রামের অনেক শিশুর সমস্যার সমাধান সম্ভব।
তুরস্কের অন্যতম শীর্ষ পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট, কার্ডিয়াক সার্জারি অ্যাসোসিয়েশন অব তুরস্কের বোর্ড সদস্য ও ক্যাম অ্যান্ড সাকুরা স্টেট হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ এরদেম বলেন, সাধারণত বড়দের হৃদরোগের চিকিৎসা বিভিন্ন হাসপাতালে করা হলেও জন্মগতভাবে ছোট শিশু যারা আক্রান্ত হয় তাদের চিকিৎসা সব জায়গায় করা হয় না। তাছাড়া চিকিৎসাটি বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণত পরিবার আর্থিক সংকটে চিকিৎসা সেবা থেকে পিছিয়ে পড়ছে। এই বিষয়গুলো আমাদের খুব নাড়া দেয়। পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি আর্থিকভাবে লাভজনক নয় বলে অনেক চিকিৎসক এই বিষয়ে পড়তে আসেন না, ফলে অসংখ্য শিশুকে জন্মগত ত্রুটি নিয়েই বড় হতে হয় বা চিকিৎসার অভাবে ঝুঁকির মধ্যে হয়। সেজন্য আমরা বিনামূল্যে বিভিন্ন দেশে ব্যয়বহুল এই ইন্টারভেনশনাল চিকিৎসা করছি। এছাড়া শিশুদের চিকিৎসার পাশাপাশি স্থানীয় ডাক্তারদের কিভাবে এই প্রক্রিয়ায় কাজ করাতে হয়, সে বিষয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। দারিদ্র্য পীড়িত পরিবারগুলোর শিশুরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়, তাই টেকসই সমাধান হলো নিয়মিত প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং চিকিৎসা সেবাকে ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া। এই উদ্যোগের লক্ষ্য শুধু কয়েকটি শিশুর জীবন রক্ষা নয়, বরং বাংলাদেশে শিশু হৃদরোগ চিকিৎসায় দীর্ঘমেয়াদি দক্ষতা তৈরি করা। শিশুরা নিজের জন্য চিকিৎসা দাবি করতে পারে না, তাই আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় তারা প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারে না। সে জন্যই ছোট শিশুদের বাঁচার সুযোগ দিতে হবে। তাই বাংলাদেশের শিশুদের সাহায্য করার জন্যই আমি তৃতীয়বারের মতো এখানে এসেছি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (হৃদরোগ বিভাগ) ডা. আনিসুল আউয়াল বলেন, মুনতাদা ফাউন্ডেশনের লিটল হার্টস প্রকল্পের আওতায় তুরস্কের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমাদের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ এবং শিশুদের জটিল হৃদরোগের চিকিৎসা পরিচালনা করছেন। এক বছরের কম বয়সী থেকে ১২ বছর পর্যন্ত শিশু এতে সেবা পাচ্ছে। চিকিৎসা করতে গিয়ে একই শিশুর এএসডি ও ভিএসডি দুটি ত্রুটি দুইটি ডিভাইসের মাধ্যমে ঠিক করা হয়েছে। এই কর্মসূচি চলাকালীন সময়ে চিকিৎসার পাশাপাশি পুরো ক্যাথল্যাব টিমকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে চট্টগ্রামেই এই সেবা নিয়মিতভাবে চালু রাখা যায়। দলটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ৪–৫ মাস পর আবার এসে স্ক্রিনিংয়ে বাদ পড়া বাকি শিশুদের চিকিৎসাও তারা করবে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজওয়ানা রিমা বলেন, চট্টগ্রামে ক্যাম্পেইনের প্রথম দিন আমরা ১০ জন রোগীর প্রসিডিউর করেছি। পরের দিন আরো দুইজনের করার পরে আমাদের সাথে তুরস্কের পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট ডা. আবদুল্লাহ এরদেম যোগ দেন। দাতা সংস্থা মুনতাদা এইডের মূল লক্ষ্য শুধু ডিভাইস সরবরাহ করা নয়, স্থানীয় চিকিৎসকদের দক্ষতা বাড়ানোও তাদের একটি প্রধান উদ্দেশ্য। ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়মিতভাবে জন্মগত হৃদরোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। মুনতাদা এইডের স্থানীয় দল হিসেবে ইতোমধ্যে অনেকগুলো কেস একসাথে করেছি। এর আগে ঢাকায় সিএমএইচ, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালসহ অন্তত চারটি মিশনে কাজ করেছি। এছাড়া ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ডিভাইস ক্লোজার ও সার্জারি হয়েছে অনেক রোগীর।
উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্য ভিত্তিক দাতা সংস্থা মুনতাদা এইড দল বাংলাদেশে তাদের ৫৭তম মিশন শুরু করেছে ২০২৫ সালে। এই মিশনে তারা বাংলাদেশে জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের চিকিৎসা ও ত্রুটি বন্ধ করার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করবে। এ পর্যন্ত সংস্থাটি স্থায়ী কার্ডিয়াক সেন্টারে ৭৪১টি হার্ট প্রক্রিয়া এবং দেশে ৫টি ‘লিটল হার্টস’ মিশন সম্পন্ন করেছে। আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশ, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ প্রায় ১৪টি দেশে তিন হাজারের বেশি শিশুদের হৃদরোগের ইন্টারভেনশনাল চিকিৎসা করেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আগে তারা ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্স ইন্সটিটিউট (আইসিএইচআরআই) এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালে এই চিকিৎসা সেবা দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী চ্যারিটি সেবার অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্টরা বিনামূল্যে বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।












