“সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমশ: প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী চলচ্চিত্রকার। বিভিন্ন চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের জন্য যে বক্তব্য রেখে গেছেন তা যদি আমরা অনুধাবনে সমর্থ হই তবে আমাদের মূল্যবোধ সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে উঠবে। এজন্য সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলো বার বার দেখা আমাদের জন্য জরুরি ” –এমনটাই বলেছিলেন সত্যজিৎ রায় রেট্রোসপেক্টিভ অধিবেশনের উদ্বোধনী দিনে আমন্ত্রিত বক্তাগণ। গত ৩১ মে–১ জুন ২০২৪ চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো দুই দিন ব্যাপী সত্যজিৎ রায় রেট্রোসপেকটিভ। উদ্বোধন করেন ডাঃ এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন : আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, চট্টগ্রাম–এর পরিচালক ব্রুনো ল্যাকর্যাম্প, বিশিষ্ট অনুবাদক ও চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক আলম খোরশেদ, ড. গুরুপদ চক্রবর্তী এবং চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সভাপতি শৈবাল চৌধূরী। সত্যজিৎ রায় রেট্রোস্পেকটিভে চারটি চলচ্চিত্র দেখানো হয়। এগুলো হলো: অশনি সংকেত, গণশত্রু, শাখাপ্রশাখা, আগন্তুক।
প্রতিবারের মতো এবারও চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রকাশ করেছে ডিপ ফোকাস : সত্যজিৎ রায় সংখ্যা। সংখ্যাটি বেশ গুরুত্ব রাখে। দেশি–বিদেশি চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক, সত্যজিৎ অনুরাগীদের সমৃদ্ধ লেখা আছে। শৈবাল চৌধূরীর সম্পাদনায় ফোকাস–এর এবারের সংখ্যায় আছে পঁচিশটি প্রবন্ধ ও একটি কবিতা।
যাঁরা লিখেছেন: সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় (শহরের অলৌকিকতা: সত্যজিৎ রায়), হিরন্ময় গঙ্গোপাধ্যায় (সত্যজিৎ রায় : আমার চোখে), সৌমিত্র দস্তিদার (সত্যজিৎ রায়, ক্যাথরিন বার্জ এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা), পল্লল ভট্টাচার্য (এমন রাজা, ক’জন হয়), কমলেশ দাশগুপ্ত ( সত্যজিৎ রায় : এক সুদূরপ্রসারী দিগন্ত), Dr. John W. Hood ( Ray on a Desert Island), আলম খোরশেদ (রায়–এর আগন্তুক, আগন্তুক– এর রায়), ইকবাল করিম হাসনু ( নির্যাসের পূর্বাভাস), আনোয়ার হোসেন পিন্টু (সত্যজিৎ : আরেক সূর্যোদয়), বাবলু ভট্টাচার্য (হিচকক ও সত্যজিৎ : দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল), বিধান রিবেরু (অশনি সংকেত : চাপিয়ে দেয়া মন্বন্তরের আখ্যান), ড. মো. মোরশেদুল আলম (সত্যজিৎ রায় : চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র), Nazmul Alam Emon ( Satyajit Ray : A Pioneer of Cinema), Rajesh Al-Rashid ( Did Satyajit Ray Accuse Steven Spielberg of Plagiarism?), খন রঞ্জন রায় (সত্যজিৎ রায় : শৈশবেই তাঁকে জেনে যাই) শাহ মো: আতিকুল হক (তারাশঙ্কর ও সত্যজিতের জলসাগর), Sanjoy Biswas (Satyjait Ray’s Aural Poetry : A Symphony of Everyday Life), হিল্লোল দত্ত ( ধর্মকারার প্রাচীরের সত্যবজ্র), বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী (অশনি সংকেত দুর্ভিক্ষের এক হৃদয়গ্রাহী আখ্যান), ইরা আহমেদ ( পথের পাঁচালী : ফিল্ম ডিটেলসের এক আকরখানি), শহিদুল ইসলাম রিয়াদ ( ত্রয়ীর তরুণযুগল), মাহমুদুর রহমান (সত্যজিতের সিনেমার অনাগত সময়ের জীবন–দর্শন), মনিরুল মনির ( হরফ সন্ধানে সত্যজিৎ রায়), অপূর্ব রঞ্জন বিশ্বাস ( প্রসঙ্গ : অন্তদৃষ্টি), সত্যজিৎ রায় ( আমার সঙ্গীত ভাবনা। অনুবাদ: শৈবাল চৌধূরী), শাহীন মাহমুদ (আমি তো আপনাকে ঈশ্বর মানি)।
২ মে সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন। ডিপ ফোকাসের এই সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে : “সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষকে স্মরণে রেখে জন্মমাসে আমরা তাঁকে আন্তরিক শ্রদ্ধা অর্পণ করছি এই রেট্রোসপেকটিভ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। ” চট্টগ্রামে এই ধরনের আয়োজনকে অভিনন্দন জানাই।
চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের নিয়মিত প্রকাশনা “ডিপ ফোকাস” সত্যজিৎ রায় সংখ্যা আসলেই একটি অমূল্য দলিল হয়ে গেল চলচ্চিত্রমোদীদের কাছে। কারণ: সত্যজিতের চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্র দর্শন, সঙ্গীতসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানার সুযোগ হয়ে গেছে।
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ: “তাঁকে একটি শিশুর চোখ দিয়ে ইতিহাসকে দেখতে হয় যেভাবে ‘পথের পাঁচালী’তে আখ্যানের পক্ষে নিরপেক্ষ এক ‘অপর’–এর অবস্থান, সেভাবেই। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’–র অন্তিম বালকটিও বাইরে থেকেই ইতিহাসকে বিচার করে। পিকু যেমন নির্জন থেকে যৌনতার সংকটকে দেখতে পায়, সত্যজিৎ রায় নিজেও সীমানার বাইরে থেকে নাগরিকতার ঊনিশশতকীয় উত্থান ও শেষ বিশ শতকের ডানাভাঙা জটায়ুকে দেখতে পান, উল্লাস ও বিরক্তি যুগপৎ তাঁকে ঘিরে ধরে। আমার বিবেচনায় তিনি মোটেও উদাসীন নন, বরং অতিরিক্ত সংরক্ত। কলকাতা তাঁর পক্ষে পথভ্রষ্টা এক প্রণয়িনী।” ( শহরের অলৌকিকতা : সত্যজিৎ রায়)
“ঋত্বিক, মৃণাল যদি সিনেমায় গদ্য লিখে থাকেন, সত্যজিৎ রায় অবশ্যই তাহলে ধ্রুপদী কবিতা লিখে গেছেন একের পর এক সিনেমায়। আজকের দুনিয়ায় যাবতীয় জটিলতাকে কষাঘাত করে গেছেন রায়”– এমনটাই লিখেছেন সৌমিত্র দস্তিদার তাঁর প্রবন্ধে (সত্যজিৎ রায়, ক্যাথরিন বার্জ এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা)।
“নির্যাসের পূর্বাভাস” প্রবন্ধে ইকবাল করিম হাসনু সত্যজিৎ রায়কে বিশ্লেষণ করেছেন অন্য এক মাত্রায়। তিনি লিখেছেন: “চলচ্চিত্র স্রষ্টা হিসেবে সত্যজিৎ ধ্রুপদী মানসিকতার। তাঁর প্রতিটি শিল্পকর্ম নির্মাণের নিটোলতাকে লক্ষ্য করে অগ্রসর হয়। সমন্বিত শিল্পমাধ্যম হিসেবে শিল্পের অপরাপর শাখার ওপর দক্ষতা একজন সফল চলচ্চিত্রকারের জন্য অপরিহার্য। সত্যজিৎ সেটি কেবল আয়ত্ত করেই ক্ষান্ত হননি। নিজের বলয়ে থাকা অন্য একটি মাধ্যমের ( গ্রাফিক্স) কলাকৌশলের দ্যুতিময় ছটায় তিনি চলচ্চিত্রের কলা–কুশলীব তথা ক্রেডিট টাইটেলসকেও করে তুলেছেন অনন্য।”
সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র “আগন্তুক” প্রসঙ্গে আলম খোরশেদ লিখেছেন: “তিনি তাঁর সারাজীবনের চিন্তাভাবনা, জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধান থেকেই আসলে এই সত্যে উপনীত হয়েছিলেন এবং তারই সারাৎসারটুকু, বলা ভালো, জীবনের শেষ রায়টি তিনি নির্ভীক ও দ্বিধাহীনভাবেই ঘোষণা করে গেলেন তাঁর সর্বশেষ চলচ্চিত্রিক শিল্পকর্ম, ‘আগন্তুক’–এর অনাড়ম্বর ক্যানভাসে।”
সঙ্গীত নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের নিজের চিন্তাভাবনা কেমন, তা তিনি নিজেই লিখেছেন “আমার সঙ্গীত ভাবনা” লেখায়। এটি পড়তে গিয়ে অন্য অন্য এক সত্যজিৎ আবিষ্কৃত হয়। তিনি লিখেছেন: “চলচ্চিত্রে সঙ্গীত প্রয়োগের ক্ষেত্রে যা কিছুই আমি করেছি তা এই দৃঢ় বিশ্বাসে করেছি যে, সঙ্গীত চলচ্চিত্রে একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে আবহ সঙ্গীত। আবহ সঙ্গীত একটি দৃশ্যের অন্তর্নিহিত ভাবকে মূর্ত করে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহযোগী ভূমিকা পালন করে সফলতার সঙ্গে।” শৈবাল চৌধূরীর অনুবাদে সত্যজিৎ রায়ের এই লেখা ডিপ ফোকাস–এর অনন্য সংযোজন।
চলচ্চিত্র জগতের বাইরে অন্য আরেক সত্যজিৎ সন্ধান করেছেন মনিরুল মনির। যিনি নিজে প্রকাশনার সাথে যুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই সত্যজিতের কাজ তাঁকে আকর্ষণ করে। তিনি তাঁর “হরফ সন্ধানে সত্যজিৎ রায়” শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন: “সত্যজিৎ রায়ের ইলাস্ট্রেশন, মোটিফ ও সর্ব প্রকার অংকন বাংলা প্রকাশনা তথা সিনেমার নান্দনিক বৈচিত্র্যকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। ক্লান্তিকর একঘেয়েমি কাটিয়ে মসৃণ ও সহনীয় দৃষ্টির এই অক্ষর বা হরফ শিল্প আমাদেরকে আনন্দ দেয়।”
সত্যজিৎ রায় এখন নেই। পরলোকগমন করেছেন। কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র ও বাংলা সংস্কৃতিতে তিনি কী লোকান্তরিত? এই বিষয়টির অবতারণা করেছেন আনোয়ার হোসেন পিন্টু। তিনি লিখেছেন: “সত্যজিতের মৃত্যুকে আমরা তাই অস্বীকার করছি। যেমন তিনি করেছেন তাঁর প্রামাণ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ’– এ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকে। ছবিটি শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু যাত্রা দিয়ে। শব্দপথে শুনি স্বকণ্ঠে সত্যজিতের ভাষ্য: ১৯৪১ এর ৭ আগস্ট কলকাতায় এক ব্যক্তির মৃত্যু হল, তাঁর দেহ আগুনে আহুতি দেয়া হল। কিন্তু যে উত্তরাধিকার তিনি রেখে গেলেন, কোন আগুনের ক্ষমতা নেই তাঁকে নিঃশেষ করে….।” কথা শেষের সাথে সাথে পর্দায় দেখি শ্মশানের আগুনের শিখাকে ছাপিয়ে সূর্যোদয় হচ্ছে আকাশে। এই নবারুণ যেমন রবীন্দ্রনাথের, তেমনি ৫১ বছর পর বাংলার আকাশে সেই নবারুণে যেন খুঁজে পাই সত্যজিতের মুখ।” ( সত্যজিৎ : আরেক সূর্যোদয়)
চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের “ডিপ ফোকাস” সংখ্যাটি সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে প্রকাশ করায়, নবীন প্রজন্মের চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীদের তো বটেই, চলচ্চিত্রমোদীদেরও সত্যজিৎ রায়কে আরো গভীরভাবে জানা ও চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রেরণা দেবে আশা করি। সংগ্রহে রাখার মতো একটি প্রকাশনা।