মানুষের জীবনের চেয়ে দামী আর কিছু হতে পারে না। জীবন একটাই। এই এক জীবনে বহু ঘটনা ঘটে। কে কোথায় হোঁচট খাবে, কে কতোটা এগিয়ে যাবে, কার জীবন কোথায় চিরকালের জন্য শেষ হয়ে যাবে.. কেউ বলতে পারে না। সুখ –দুঃখ, আনন্দ– বেদনা, ভালো– মন্দ, চাওয়া– পাওয়া, হাসি– কান্না ইত্যাদির সংমিশ্রণে জীবনের স্রোত এঁকেবেঁকে যায়। কেউ ভালোবাসার মানুষ দ্বারা আবৃত থাকে চিরকাল। কেউ বা একা নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে দেয়… আশে পাশের মানুষজন থাকা সত্ত্বেও হৃদয়ের হদিস পায় ক‘জনে? জন্ম স্বাভাবিকভাবে হলেও মৃত্যু অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আসে।
আমরা প্রায়ই পত্রপত্রিকা এবং বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় দেখতে পাই আত্মহত্যার বিভিন্ন ঘটনা। এটা দেশে বিদেশে সব জায়গাতেই ঘটছে। এর কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ জনই ডিপ্রেশনে ভুগছিলো।
ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতাকে আমরা অনেকেই হালকাভাবে নিলেও এটা একটা মারাত্মক ব্যাধি। এর শেষ পরিনাম হতে পারে ‘সুইসাইড‘। সহজভাবে বিষন্নতাকে মন খারাপও বলা যায়। কিনু্ত এই বিষণ্নভাব যদি নাওয়া, খাওয়া, ঘুম, আনন্দ, আগ্রহ হটিয়ে গেড়ে বসে দিনের পর দিন তখন তা আর সাধারণ মন খারাপে সীমাবদ্ধ থাকে না। ডিপ্রেশনে রূপ নেয়। আমি, আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছি কিনা কিভাবে বুঝবো?
কোথাও যেনো শান্তি নাই, শান্তি নাই। সর্বক্ষণ অস্থির, চিন্তিত, ভীত কিংবা শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সমস্ত অনুভূতি, চিন্তাচেতনা, কাজকর্মের উপর নেগেটিভ প্রভাব ফেলে।
এই ডিপ্রেশনের বয়সভেদে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে।
১. অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় ভালো করতে না পারা, পারিবারিক জটিলতা বিশেষ করে বাবা মা’র সম্পর্কের শীতলতা। ডিভোর্স বা হীনমন্যতায় ভোগা, প্রাপ্য সম্মান না পাওয়া ইত্যাদি।
২. শারীরিক সমস্যা যেমন স্থুলতা, কোন জটিল ব্যাধি.. ক্যান্সার, কিডনি ইত্যাদি নানারকম ব্যাধি যখন দিনের পর দিন জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে..
৩. আর্থিক সমস্যা, ইগো সমস্যা, নারীদের হরমোনের সমস্যা, মাদক সেবনের ইতিহাস,পরকীয়া সম্পর্ক ইত্যাদি অনেক সমস্যাই ডিপ্রেশনের ঝুঁকিকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রতিটি ডিপ্রেশনের পিছনে হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস, অতৃপ্তি লুকিয়ে থাকে। অনেকেই পরিকল্পিত ভাবে সুইসাইডকে বেছে নেন। জীবনের সব আশা ভরসা, স্বপ্ন যখন খাদের কিনারে এসে দাঁড়ায়, বেঁচে থাকা তখন অর্থহীন হয়ে যায়। জীবনে নানারকম ঘাত– প্রতিঘাত আসবেই। এতো সহজে হাল ছেড়ে দিলে হয় না। মেরুদণ্ড সোজা রেখে যুদ্ধ করে যেতেই হয়। তবে না জীবনের সার্থকতা। পরিচিত কেউ যখন সুইসাইড করে, তখন আমাদের বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখ জলে ভরে উঠে।
বার বার মনে হয়,যদি তার মনের কথা জানা যেতো, যদি একটু ভালোবাসা, সহানুভূতি দিয়ে তার ভিতরের দুঃখকে ভুলিয়ে দেওয়া যেতো। তাহলে এমন দিন হয়তো দেখতে হতো না। চোখের সামনে দেখা কিছু উদাহরণ না দিলেই নয়।
কিছুদিন আগেই ফেসবুকে জনপ্রিয় একটি গ্রুপ ‘পেন্সিল’এর ক্রিয়েটর এডমিন সুইসাইড করেন।
তাঁকে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। এমন তরতাজা ক্রিয়েটিভ একজন ব্যক্তি কিভাবে আত্মহননের পথ বেছে নেন? কিনু্ত অন্তরের অভিমান বুঝার কেউ হয়তো ছিলো না। উনি ডিপ্রেশনে ছিলেন।
কয়েকমাস আগে প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সাদী মুহাম্মাদও আত্মহননের পথ বেছে নেন। তিনিও ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন।
এমন বহু মানুষ আছেন যারা আর্থিক সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ডিপ্রেশনে চলে যান এবং শেষতক আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’ জেনেও এই পথেই তারা শান্তি খুঁজেন।
যখন আমরা বুঝতে পারি, কেউ ডিপ্রেশনে ভুগছে.. অতিসত্বর একজন সাইকোথেরাপিষ্টের সাথে কথা বলতে হবে। তিনিই রোগীর সাথে কথা বলে বুঝতে পারবেন, কী ধরনের থেরাপি দরকার। সেটা যদি সম্ভব না হয়, ডিপ্রেশনের রোগীকে নিজেদের সাহচর্যে রেখে তাকে বুঝাতে হবে, তার অসুবিধা দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।
ডিপ্রেশন শুধুমাত্র মানসিক ব্যাধি নয়। এটা একজন সুস্থ, সবল মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই ডিপ্রেশন থেকে নিজেকে বের করতে হলে শারীরিক পরিশ্রমের সাথে সাথে মানসিক পরিচর্যা প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক