ডিজিটাল যুগে হালখাতার হালচাল

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ৬ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

বাজছে ঢাক তাকদুম তাকদুম। দূর থেকে ভেসে আসছে সানাইয়ের সুর। প্রত্যাশা একটি ভালো দিনের সূচনার। দোকানে দোকানে বাহারি ফুল আর ফেস্টুনের সাজসজ্জা। ব্যানারে সাঁটানো ‘শুভ নববর্ষ, শুভ হালখাতা’। নতুন পোশাক আর হিসাবের নতুন খাতা খুলে ভোক্তাদের জন্য দোকানির অধীর অপেক্ষা। পুরাতন বছরের বকেয়া পরিশোধের পর মিষ্টিমুখ। একে অন্যকে জড়িয়ে কোলাকুলি। বাঙালির চিরচেনা মিলনমেলার উৎসব হালখাতা উদযাপনের এমন দৃশ্য আজ আর নেই বললেই চলে। প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি ও পারস্পরিক আস্থার সংকটে চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব অনেকটাই রং হারিয়েছে। একই সাথে সরকার নির্ধারিত বাংলা বর্ষপঞ্জি ও সনাতনী পাঁজির পার্থক্যের কারণে চট্টগ্রামে অনেকটাই জৌলুস হারিয়েছে হালখাতার উৎসব। তবে হালখাতার চল এখনো আছে চট্টগ্রামের কিছু কিছু স্থানে। নতুন বছর শুরু। শুরু নতুন একটি খাতা খোলা, হিসাব-নিকাশ হালনাগাদ করা। দোকানগুলোতে আগের মতো এ চিত্রের দেখা এখন মেলে না। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হাতে লেখা খাতা থেকে অনেককে নিষ্কৃতি দিয়েছে। ১০/১৫ বছর আগেও আড়ত ও দোকানগুলোতে হালখাতার যে জাঁকজমক অনুষ্ঠান দেখা যেত তা এখন আর নেই। আগে ব্যবসায়ীরা মুখের কথায় বিশ্বাস করে লাখ লাখ টাকা বাকি দিতেন। তার বেশিরভাগই উসুল হতো হালখাতার দিনে। এখন লেনদেনটা অনেকে ব্যাংকের মাধ্যমে করেন। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে আয়োজনের ধরন। সেই দিন আর নেই। নেই সেই হালখাতা উৎসবও। অথচ সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রাণ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারো মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। এরপর মোগল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। এর সাথে শুরু হয় বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। মোগল আমল থেকেই পয়লা বৈশাখে অনুষ্ঠান করা হতো। প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতেন এবং পয়লা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টি মুখ করানোর পাশাপাশি আনন্দ উৎসব করতেন। এছাড়া ব্যবসায়ী ও দোকানদার পয়লা বৈশাখে ‘হালখাতা’ করতেন। কিন্তু ডিজিটালের ভিড়ে বাঙালির ঐতিহ্য হালখাতা যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যের হালখাতা উৎসব আজ আধুনিক যুগের অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কাছে টিকতে পারছে না।
নগরীর হাজারী গলি, চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জে এ আয়োজন এখনও কিছুটা আছে। ব্যবসায়ীরা জানান, অধিকাংশ ব্যবসায়ী নতুন খাতা শুরু করেন নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তার নামে। হিন্দুরা পয়সায় সিঁদুর মেখে নতুন খাতায় ছাপ দেন। এরপর শুরু করেন নতুন বছরের লেনদেনের হিসাব। হালখাতা উৎসব শুধু হিসাবের নতুন খাতা খোলার বিষয় নয়, পাওনা আদায়ের পাশাপাশি ক্রেতাদের আপ্যায়নের বিষয়টিও জড়িয়ে আছে।
খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঘুরে চিরচেনা হাতে লেখা খাতার ব্যবহার বেশি দেখা যায়নি। দোকানে কম্পিউটার বা মোবাইলের মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনার হিসাব রাখা হচ্ছে। ফলে ক্যাশিয়ারের পাশে থাকা চিরচেনা লাল কাপড় বা কাগজে মোড়ানো হিসাবের হালখাতার বইটিও চোখে পড়েনি তেমন। এছাড়া হালখাতা অনুষ্ঠানে আগ্রহ নেই নতুন প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের কাছে। তাই বাংলা বছর শেষে দোকানে দোকানে যে হালখাতার অনুষ্ঠান হতো তাও আজ হারিয়ে যাচ্ছে।
টেরীবাজারের চিটাগাং ফেব্রিকস স্যুটিং হাউসের স্বত্বাধিকারী মো. শওকত ওসমান চৌধুরী আজাদীকে জানান, যারা পুরনো ক্রেতা তাদের নিমন্ত্রণ করা হয়। তবে আগে ক্রেতাদের উপহার দিলেও এখন আর তা দেওয়া হয় না। তিনি বলেন, হালখাতার আবেদন আগের চেয়ে অনেক কমেছে এটা ঠিক, তবে একেবারে ফুরিয়ে যায়নি।
নবীন ব্যবসায়ী ও নিউ মার্কেটের রণি জুয়েলার্সের কর্ণধার রুবেল সাহা আজাদীকে বলেন, আগে হালখাতা উৎসবে অন্যরকম আনন্দ ছিল। যার যার সাধ্যমতো কার্ড ছাপানো হতো। ব্যাপক পরিসরে উৎসব আনন্দে হালখাতা পালন করা হতো। কিন্তু বর্তমানে চাকরিজীবী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী প্রায় সবাই ইংরেজি মাসের ওপর ভিত্তি করে আয়-ব্যয় করেন। নগদ বিক্রি অথবা বাকি লেনদেন সবই হয় ইংরেজি মাসের ওপর ভিত্তি করে। তাই ধীরে ধীরে পহেলা বৈশাখে হালখাতা প্রথা হারিয়ে যাচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদ বাজার ঘিরে ডাকাতির প্রস্তুতি
পরবর্তী নিবন্ধবাইডেনের চিঠি এসেছে, তারা চুপসে যাবে : তথ্যমন্ত্রী