বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ক্যাশ লেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের একাত্মতা প্রকাশ করা শুরু করেছে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। এই যেমন গত জানুয়ারিতে চা খেয়ে Bangla QR এর মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজাল একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর চায়ের দোকানে Bangla QR এর মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করেন। এভাবে বিষয়টি ধীরে ধীরে সহজ ও গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। দেশের ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থায় এভাবে যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা।
ডিজিটাল ব্যাংক এ বছরই– এমন কথা আমরা শুনি অর্থমন্ত্রী জনাব আ হ ম মুস্তফা কামাল এর নিকট থেকে সম্প্রতি বাজেট উপস্থাপনকালে। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়া দ্রুততর এবং এর পরিধি ব্যাপকতর করার কৌশল নির্ধারণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি কমিটি কাজ করছে। এই কমিটি ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের রূপরেখা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। আশা করছি, আগামী ২০২৩–২৪ অর্থবছরেই ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপন করা যাবে। আমরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ক্রেডিট স্কোরিং সিস্টেম চালু করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের দিকে নজর আছে বিদেশীদেরও। গত ১৪ জুন রাজধানীর একটি হোটেলে কয়েকটি পত্রিকার সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে জাপানের সাবেক উপমন্ত্রী এবং সাইফার কোরের চিফ অপারেটিং অফিসার মোটোইউকি ওদাচি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করার জন্য ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার ওপর জোর দেন তিনি। সার্টিফাইড পাবলিক অ্যাকাউন্ট্যান্ট ওদাচি এ সময় বলেন, ‘ছয় বছর আগে আমি ঢাকায় এসেছিলাম। বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলো দেখে আমি বিস্মিত। একটি স্মার্ট অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে সমর্থন করার জন্য নগদ টাকার লেনদেন এড়িয়ে চলা উচিত। নগদ টাকার লেনদেনের ঝামেলা এড়াতে সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (সিবিডিসি) সিস্টেম গ্রহণ করা উচিত। বৈশ্বিক জিডিপির ৯৫ শতাংশের বেশি প্রতিনিধিত্বকারী ১১৪টি দেশ এখন সিবিডিসি সিস্টেম নেওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। আটলান্টিক কাউন্সিলের মতে ২০২০ সালের মে মাসে ৩৫টি দেশ সিবিডিসি সিস্টেম গ্রহণ করেছে। ২০২৩ সালে ২০টিরও বেশি দেশ সিবিডিসিকে পাইলট হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে। অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং রাশিয়া সিবিডিসি সিস্টেমের পাইলট শুরু করতে চায়।’ এ সময় উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) গবেষক তাকাতোশি নাকামুরা বলেন, সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (সিবিডিসি) সিস্টেমের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানো যেতে পারে। একই সঙ্গে ক্যাশলেস লেনদেন এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্মার্ট করতে পারে। তাই ডিজিটাল অর্থনীতিতে রূপান্তর করতে সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (সিবিডিসি) সিস্টেম গ্রহণ করার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। সিবিডিসি নোট ইস্যু করার খরচ কমানোর মাধ্যমে নগদ অর্থ ব্যবস্থাপনা করে থাকে। জাপানি সিবিডিসি সিস্টেম কোম্পানি সাইফার কোরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তাকাতোশি নাকামুরা বলেন, ডিজিটাল মুদ্রা ডিজিটাল অর্থনীতির সম্প্রসারণ এবং কর আদায়ের হারকে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে। ইন্দোনেশিয়ায় শত শত দ্বীপ রয়েছে শহর থেকে অনেক দূরে। সেখানে নগদ টাকা লেনদেনের জন্য কোনো অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) বুথ নেই। সিবিডিসি সিস্টেম শুধু ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে দুর্গম জায়গাতেও আর্থিক সেবা পৌঁছাতে পারে এবং সেবা দিতে পারে। .. সিবিডিসির মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি অর্জন করা সম্ভব যেখানে সব নাগরিক উপকৃত হতে পারবেন।’–সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ জুন, ২০২৩ খ্রি:
সম্প্রতি ভারতের জি নিউজ একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ভারতে ক্যাশ লেস হওয়ার পথে এবার বাজারের আলু পটলের দোকানও। সেখানের দোকানিরা বলছেন, এছাড়া উপায়ই বা কী! খুচরোর আকালে ব্যবসা লাটে ওঠার দশা। তাই সহজে বেচাকেনা করতে এখন ঊ–ওয়ালেট চালু করেছেন দোকানিরা।
আমাদের দেশেও দ্রুত বাড়–বাড়ন্ত হয়ে উঠতে পারে এই ডিজিটাল ব্যাংকিং। ক্যাশলেস সোসাইটির যুগে যেতে নানামুখী প্রচেষ্টা ইতিমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
কিভাবে কাজ করবে এই ডিজিটাল ব্যাংক?
ডিজিটাল ব্যাংকের কোনো শাখা, উপশাখা, এটিএম বুথ বা কোনো স্থাপনা থাকে না। এই ব্যাংক কোনো ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) সেবা দেয় না। সব সেবাই হবে অ্যাপনির্ভর, মোবাইল ফোন বা ডিজিটাল যন্ত্রে। দিন–রাত ২৪ ঘণ্টাই সেবা মিলবে। গ্রাহকদের লেনদেনের সুবিধার্থে ডিজিটাল ব্যাংক ভার্চুয়াল কার্ড, কিউআর কোড ও অন্য কোনো উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক পণ্য দিতে পারবে। এক ব্যাংকের সেবা নিতে গ্রাহকেরা অন্য ব্যাংকের এটিএম ও এজেন্টসহ নানা সেবা ব্যবহার করতে পারবেন। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা যে কেউ সহজেই পরিশোধ সুবিধা দিতে এ ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। এতে যে কোনো পরিশোধের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্রিজ, কালভার্টের টোল আদায়ও সহজ হবে। গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করতে ডিজিটাল ব্যাংক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ব্লক চেইন এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অন্যান্য অগ্রিম প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইন এন্ড–টু–এন্ড প্রযুক্তিভিত্তিক ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের মাধ্যমে দক্ষ, কম খরচে এবং উদ্ভাবনী ডিজিটাল আর্থিক পণ্য এবং পরিষেবা দেবে। ডিজিটাল ব্যাংক এর বেলায় স্বচ্ছতার বিষয়টি বেশি আলোচনায় আসে। এখানে শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রাহক পর্যন্ত সব জায়গায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডিজিটাল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক কারা হবেন, কাদের হাতে যাবে মালিকানা এই বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। ডিজিটাল ব্যাংক গড়ে তুলতে গেলে সঠিক ডেটাবেজ লাগবে। যেসব লোকের হাতে স্মার্টফোন নেই, তাহলে ডিজিটাল ব্যাংকিং কী রকম হবে সেসব বিবেচনায় রাখতে হবে। ডিজিটাল ব্যাংক হলেই সঙ্গে সঙ্গে মুনাফা করবে, তা নয়, এটা পরিপক্ব হতে সময় লাগবে। আর্থিক বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানের অভাব ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য বড় বাধা হতে পারে।
বাংলাদেশে ক্যাশলেস সোসাইটি কিভাবে কাজ করবে এর একটা ধারণা নিতে পারি গত ১৮ জানুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার একটি প্রতিবেদন থেকে। ‘ক্যাশলেস সোসাইটির যুগে বাংলাদেশ’ শিরোনামে। এতে বলা হয়, ‘স্যার জুতা পলিশ করেন…নগদ টাকা দিতে হবে না। কিউআর কোডের মাধ্যমে টাকাটা আমাকে মোবাইলের দিয়ে দিলেই হবে। এখন আর খুচরা টাকা নিয়ে ঝামেলা নাই স্যার।’ রাজধানীর মতিঝিলের সেনা কল্যাণ ভবনের সামনের ফুটপাতে বসে এভাবেই সেবা নেওয়ার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন শাপলা।
প্রথমবার দেখে বোঝার উপায় নেই ফুটপাতে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেনের বিষয়টি। কিছুটা সামনে যেতেই চোখে পড়ল বাক্সের ওপর রাখা মোবাইল ব্যাংকিং এর কিউআর কোড। মতিঝিলের সেনা কল্যাণ ভবনের সামনে গিয়ে দেখা গেল এ চিত্র। ক্যাশলেস বা নগদবিহীন বাংলাদেশ প্রচারণার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সর্বসাধারণকে কিউআর কোডের পেমেন্টসহ সব ডিজিটাল লেনদেনের সুফল সম্পর্কে জানাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে চা–দোকান, মুদি–দোকান, হোটেল, মুচিসহ ভাসমান বিক্রেতাদের কিউআর কোড সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সেবা বিল পরিশোধ করতে পারছেন গ্রাহকেরা। ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের আওতায় শ্রমনির্ভর অতিক্ষুদ্র ভাসমান উদ্যোক্তা (চা বিক্রেতা, ঝালমুড়ি বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা), বিভিন্ন প্রান্তিক পেশায় (মুচি, নাপিত, হকার) নিয়োজিত সেবা প্রদানকারীদের বিল গ্রহণ পদ্ধতিকে ডিজিটাল ও প্রাতিষ্ঠানিক করার উদ্দেশ্যে ব্যক্তিক রিটেইল হিসাব খোলা হচ্ছে। এ হিসাবের অধীন যেসব ব্যবসায়ী, তাঁদের ব্যবসায়িক লেনদেন সম্পন্ন করবেন, তাঁরা মাইক্রো–মার্চেন্ট হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘এতদিন একটি ব্যাংকের কিউআর কোডে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের গ্রাহক পেমেন্ট করতে পারত। এখন এক ব্যাংকের কিউআর কোড থাকলে যেকোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন করা যাবে’।
ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন স্মার্ট বাংলাদেশ হতে চায়। ডিজিটাল ব্যাংক ও ক্রেডিট স্কোরিং ব্যাপকভাবে প্রচলনের এখনই সময়। ক্যাশলেস ইকোনমি হলো ভিশন বাস্তবাায়িত করার অন্যতম হাতিয়ার। নগদবিহীন অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে আমরা এখন এগিয়ে যেতে পারি। আমরা ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে অনেক সময় ও ঝামেলা বাঁচাতে পারি। এভাবে নিকট ভবিষ্যতে নগদবিহীন সমাজ গঠিত হবে।
লেখক: উপ–পরিচালক (তথ্য ও প্রকাশনা),
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)