ডা. ফয়সলের ‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক

চমেক ও জেনারেল হাসপাতালের নথি চেয়ে চিঠি

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৫ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যের ডা. ফয়সল ইকবালের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। ঢাকা প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর গতকাল রোববার প্রয়োজনীয় নথি চেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে চিঠি দিয়েছেন দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। চিঠিতে “ডা. মোহাম্মদ ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক বিএমএ চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, বদলি, নিয়োগ বাণিজ্য, ক্লিনিক ব্যবসা, কমিশন ব্যবসাসহ জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ” অনুসন্ধানের বিষয় উল্লেখ করা হয়। এদিকে ডা. ফয়সলকে নোটিশ না দিতে দুদকে তদবিরের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের শীর্ষ এক শিল্পগ্রুপ চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারীর বিরুদ্ধে। বিষয়টি দুদকের এক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন।
সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চে দুদকের ঢাকা প্রধান কার্যালয় ও ৩০ জুন চট্টগ্রাম অফিসে জমা হওয়া অভিযোগ যাচাই বাছাই শেষে “অভিযোগ নং-৬০/২০২০” আকারে অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। গত ২৬ আগস্ট দুদকের দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল বিভাগের পরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক পত্রে অভিযোগটি অনুসন্ধানের পদক্ষেপ নিতে মহাপরিচালক (তদন্ত-২) এর কাছে অভিযোগের নথিটি পাঠানো হয়। এদিকে অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। গতকাল অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা অভিযোগের সংশ্লিষ্ট নথি চেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে পত্র দেয়।
অনুসন্ধানাধীন অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ে বিএমএ নেতা ফয়সল ইকবালের অনিয়ম-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট কয়েকটি অভিযোগ জমা পড়ে। এতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ চট্টগ্রামের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক নিয়োগ ও বদলি, আউট সোর্সিং কর্মচারি নিয়োগ, বেসরকারি ক্লিনিকে চাঁদাবাজি, এমেচার, নন এমেচার যন্ত্রপাতি ক্রয়, ওষুধ ক্রয়ের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাঁর নামে বেনামে প্লট, ফ্ল্যাটসহ বিপুল অর্থের মালিক বনেছেন তিনি।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও ওষুধ ক্রয় এবং আউট সোর্সিং কর্মচারি সরবরাহে ঘুরে ফিরে নির্দিষ্ট কয়েকটি ঠিকাদার কাজ পেয়েছেন। চমেক হাসপাতালের কোটি কোটি টাকার খাবার সরবরাহ, আউটসোর্সিং কর্মচারি সরবরাহসহ বিভিন্ন কাজের নিয়ন্ত্রণ করেন ফয়সল ইকবাল। নিজের পছন্দের ঠিকাদার ব্যতিরেখে অন্য কোনো ঠিকাদার যাতে টেন্ডারে অংশ নিতে না পারেন সেজন্য জটিল ও কঠিন শর্ত সংযোজন করে দেয়া হতো ফয়সাল ইকবালের ইন্ধনে। গত কয়েক বছরে চমেক হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।
অভিযোগে বলা হয়, বেশি লাভজনক কাজগুলো পান জম জম এন্টারপ্রাইজ। জম জম এর মালিক দিদারুল আলম হচ্ছেন তাঁর নিকটাত্মীয়। এছাড়া এস কে ট্রেডার্স, শাপলা এন্টারপ্রাইজ, এম এ কাসেম এন্টারপ্রাইজ, এম ব্রাদার্স, জিসান এন্টারপ্রাইজ, ফেরদৌস ট্রেডার্স, সাদমান এন্টারপ্রাইজ, আলী এসোসিয়েটস নামের ঠিকাদাররাই ঘুরে ফিরে চট্টগ্রামের সরকারি হাসপাতালগুলোর টেন্ডার পেয়েছেন।
ওই অভিযোগে বলা হয়, চট্টগ্রাম মহানগরীর মেহেদীবাগের যে ফ্ল্যাটে তিনি বসবাস করেন, সেটি দুই কোটি টাকায় কেনা। নগরীর সৈয়দ শাহ রোডে ছয়তলা ভবন নির্মাণ করছেন তিনি। রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় নিজ গ্রামে ১০৬ একর পাহাড়ি ভূমিতে গড়ে তুলেছেন আমবাগান ও মাছচাষ প্রকল্প। নগরীর দক্ষিণ খুলশী সিটি কর্পোরেশন আবাসিক এলাকায় ফয়সলকে সাবেক মেয়র বিনা টেন্ডারে নামমাত্র মূল্যে একটি প্লট বরাদ্দ দেন।
চমেক হাসপাতালে দেয়া নোটিশে ২০০৯ সাল থেকে অদ্যবধি আউট সোর্সিংয়ে নিয়োগকৃত কর্মচারিদের তালিকা, টেন্ডারের তালিকা, ক্রয়কৃত এমেচার, নন এমেচার যন্ত্রপাতি ক্রয়ের টেন্ডারের নথি, চাহিদাপত্র ছাড়াও চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক আকতারুল ইসলাম, টেন্ডার শাখার প্রধান মাঈনুদ্দিন, ওয়ার্ড মাস্টার রাজীব দে, হিসাবরক্ষক শাহজাহানের পুরো নাম ও পরিচয়সহ রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ, স্টোর ও টেন্ডার শাখার নথি চাওয়া হয়।
দুদকের নোটিশের বিষয়ে জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর তদন্তাধীন বিষয়ে কোন মন্তব্য করবেন না বলে জানান। অন্যদিকে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ দুদকের নোটিশ প্রাপ্তির বিষয়টি স্বীকার করেন।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম আদালতে দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ডা. ফয়সল ইকবালকে কোন নোটিশ দেয়া হয়নি। শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালে চিঠি দিয়ে টেন্ডার, আউটসোর্সিং সরবরাহের নথিসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিচয় জানতে চাওয়া হয়েছে।’
এব্যাপারে বিএমএ চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী রোববার রাতে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমি দুদকের কোন অভিযোগের বিষয়ে জানি না। কোনো নোটিশও আমি পাইনি। তবে রোববার বিকেলে কিছু গণমাধ্যমের খবরে জানতে পেরেছি- চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নোটিশ দিয়ে কিছু নথি তলব করা হয়েছে। এখানে আমার কথা হচ্ছে, আমি কোন ব্যবসায়ী নই। আমি বিএমএ’র সেক্রেটারি হিসেবে আছি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের আশপাশের কোন প্রতিষ্ঠানে আমার কোনো শেয়ার নেই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালে আমি চাকরি করি না। আমি চাকরি করতাম ২০১০ সাল পর্যন্ত পিজি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালে। ২০১০ সালে ডেপুটেশনে চট্টগ্রামে আসি। আবার ২০১২ সালে পুনরায় পিজিতে যোগদান করি। ২০১৬ সালে চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে চলে আসি।’ তিনি বলেন, ‘দুদকের এই অনুসন্ধানকে আমি স্বাগত জানাই। মেডিকেল কলেজের টেন্ডার নথি তলব করেছে দুদক। টেন্ডার একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়। নথি তলব করলে তো প্রমাণ হয়ে যাবে, কোনো ফার্মের মালিক আমি, না অন্য কেউ। সত্যিকার তদন্তের মাধ্যমে সত্যটা বেরিয়ে আসুক।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেড় হাজার টোকেন দেবে সৌদি এয়ারলাইন্স
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে বেড়েছে শনাক্তের হার