ডা. নুরুন নাহার জহুর স্মরণে

ফাহমিদা আমিন | শুক্রবার , ১২ মার্চ, ২০২১ at ৬:০০ পূর্বাহ্ণ

ডা. নুরুন নাহার জহুরের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় এক কবিতা পাঠের আসরে। ১৯৭০ সালের ৩০ অক্টোবর কবি আবদুস সালামের বাসায়। আসরে সভাপতিত্ব করছিলেন জনাব নাজমুল আলম, বাংলাদেশ বেতারের তৎকালীন আঞ্চলিক পরিচালক। প্রধান অতিথি ছিলেন পল্লীকবি জসিম উদ্দীন। আমিও কবিতা পড়েছিলাম। আমি আর নুরু আপা দুজনে একই শহরে থাকলেও তাঁর সঙ্গে আমার এর আগে পরিচয় হয়নি কোন দিন। এমন কি ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি অমি যখন ডা. খাস্তগীর স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ি, তখনও রাস্তায় বের হয়ে এসেছিলাম চট্টগ্রাম কলেজের ভাইদের ডাকেই; শুনেছি নুরু আপারাও তখন ঐ কলেজেরই ছাত্র ছিলেন, মিছিলে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন, কিন্তু আমার সঙ্গে তখনও দেখা হয় নি। নুরু আপাদের মত মহিলারা যেন জন্ম গ্রহণ করেছিলেনই নেতৃত্ব দেবার জন্যই। তাই যখন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ঢাকায় লিডারশিপ কর্মশালার আয়োজন করে আ নুরু আপা সেই কর্মশালায় যোগ দিয়ে সার্টিফিকেট আনলেন তখন আমি হেসে বলেছিলাম আপনারও আবার লিডারশিপি ট্রেনিং লাগে? আসলেই আগে তিতিক্ষায়, সমাজসেবায় আর্তের সেবায় এঁরাই ছিলেন সমাজের প্রথম সারির মহিলা।
ডা. নুরুন নাহার জহুরের জন্ম ১৯৩২ সালের ১২ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তাঁর পিতা ইঞ্জিনিয়ার ওবাইদুল হক এবং মাতা সৈয়দা জয়নাব হক। ডা. নুরুন নাহারের শৈশব কাটে পিতার কর্মস্থল বার্মায়। পিতা-মাতার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তাঁর শিশুকালের দিনগুলো কাটে। মাতা শিক্ষা দেন বাংলা ভাষা, বার্মার স্কুলে পড়তেন উর্দু, ইংরেজি। তিনি গুল-এ-জার বেগম বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আই.এ পাস করে চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুল থেকে এস.এল.এফ পাস করেন ১৯৫৮ সালে।
ডা. নুরুন নাহার জহুর বর্ণাঢ্য এক কর্মময় জীবনযাপন করে গেছেন। তিনি জেমিসন মেটারনিটি হাসপাতাল, মহিলা সমিতির চট্টগ্রাম শাখার মেডিকেল অফিসার, ঞ.ঈ.জ. ও ঋ.চ নাসিরাবাদের মেডিকেল অফিসার, ১৯৮০ সাল থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নাহার ক্লিনিক, দামপাড়া এবং ঈদগাহের মেডিকেল অফিসার হিসাবে কাজ করে গেছেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং দেশ স্বাধীন হবার পরেও তিনি অনেক কেন্দ্রে স্বেচ্ছায় চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি তিনি সমাজসেবাও করেছেন। শৈশবকালে সেই মুকুলের মাহফিলে যোগদান করা থেকে শুরু করে তিনি আজীবন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসাবে সমাজের কাজই করে গেছেন। তিনি মহিলা সমিতিতে তো বিভিন্ন পদে বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছিলেন। এছাড়া মহিলা সমবায় সমিতি,গার্ল গাইডস, ক্রীড়া সংস্থা, বাংলাদেশ নারী কল্যাণ ফাউন্ডেশন, নারী পুনর্বাসন বোর্ড, “মাতৃসংঘ” প্রভৃতি ১০/১৫টি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ছাত্রী জীবনেও তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুলে সক্রিয় থেকেছেন। ১৯৬০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর মানবিক-কাজকর্ম সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। তিনি উপদ্রব এলাকায় মানবাধিককাল স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী নিয়ে ত্রাণ বিতরণ এবং চিকিৎসাসেবা চালিয়েছেন। শেষদিকে মাতৃসংঘই তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল। এটি ছিলো দুস্থ নারী কল্যাণমূলক একটি প্রতিষ্ঠান।
একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে রাজনৈতিক জীবনেও তাঁর পদচারণা ছিল সোচ্চার। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ডা. নুরুন নাহার প্রচারণার কাজে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তীতে মন্ত্রীপত্নী হিসাবে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য/সম্পাদিকা ছিলেন। ডা. নুরুন নাহার জহুরের সাহিত্য জীবন শুরু হয় শিশুকাল থেকেই। তাঁর মাতাও ছিলেন একজন সাহিত্যসেবী। মায়ের এই গুণটি তাঁর মধ্যে এসেছিল। ১৯৪৫ সাল থেকে তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু। সত্যবাতা, বেগম, কাফেলা, ইত্তেফাক, কোহিনূর, সৈনিক, হেরেম, আজাদী, পূরবী নয়াবাংলা, স্বাধীনতা প্রভৃত পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। যশোহর থেকে “সাহিত্যরত্ন” উপাধি পাওয়া ছাড়াও সাহিত্যে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘও তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। তিনি চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের উপদেষ্টা এবং ঢাকাস্থ বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সদস্য ছিলেন। তবে লেখার ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট অলসতা, অমনোযোগিতা ছিল। নয়তো তাঁর যত লেখা আছে, তাতে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ হতে পারতো।
মাত্র সপ্তম শ্রেণীতে পাঠকালে তাঁর বিয়ে হয় ডা. সৈয়দ কছির উদ্দিন এম.বি.বি.এস-এর সঙ্গে। স্বল্পকালের সে বিবাহিত জীবন শেষ হয় স্বামীর মৃত্যুতে। কোলে তখন তাঁর চল্লিশ দিনের শিশুপুত্র এবং এক মেয়ে এক বৎসরের। ১৯৫৫ সালে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব জহুর আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে আবার তাঁর বিবাহ হয়। সে সময় তিনি মেডিকেল স্কুলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। প্রথম স্বামী মারা যাবার পরই তিনি নবম, দশম শ্রেণী পড়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। তাঁর পাঁচ ছেলে, চার মেয়ে। ছেলেরা হচ্ছেন, জিয়াউদ্দীন চৌধুরী (ব্যবসায়ী), হেলাল উদ্দীন চৌধুরী (শিল্পপতি), কমরুদ্দীন চৌধুরী (কানাডায় অধ্যয়নরত), মহিউদ্দিন চৌধুরী (ব্যাংকার), শরফুদ্দিন চৌধুরী রাজু। চার মেয়ে, সকলেই বিবাহিত। জেরিনা আহাদ (কানাডায় থাকে)। জেরিনা নাসরিন (আমেরিকায়), জেরিনা পারভিন (সিলেটে) এবং জেরিনা রোজি (ঢাকায়)।
জহুর আহমদ চৌধুরীর ইন্তেকালের পর ডা. নুরুন নাহার জহুরের দিন অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে কাটে। প্রায় রিক্তহস্তে তিনি তাঁর সন্তানদের লালন-পালন করেন। তবুও কখনো মনোবল হারান নি। সেই সময় আমি তাঁকে পরামর্শ দিতাম এইসব ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়ানোর মত অকাজ ছেড়ে বরং নিজের অধীত বিদ্যাটাই ঝালাই করে নিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করে দিন কিন্তু তখন তাঁর মন বিক্ষিপ্ত ছিল্‌ আর যে একবার সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করে তাঁর ফিরে আসা মুশকিল। তবে পরে তিনি নাহার ক্লিনিক খুলে কিছুটা স্বকর্মে মন দিতে চেষ্টা করেছিলেন।
ডা. নুরুন নাহারের মত একাধারে এত গুণ সচরাচরে দেখা যায় না। সাহিত্য, সমাজসেবা, চিকিৎসা, সংস্কৃতি, সংগীত সকল বিষয়ে অগ্রণী এবং উৎসাহী, তাঁর আঁকার হাতও খুব ভাল ছিল। কিছু না করে অংকন শিল্পী হলেও নাম করতে পারতেন। মানুষটা ছিলেন অত্যন্ত সরল-সিধা, নিরহন্‌কার। মন্ত্রীপত্নী হওয়ার পরও তাঁর আচরণে বিশেষ কোন পরিবর্তন দেখা যায় নি। আমাকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন, সম্মানও দিতেন।
মাঝে মাঝেই রিকশা নিয়ে আমার বাসায় চলে আসতেন। আমাকে নিয়ে লিখেও ছিলেন বেগমের পাতায়। মানুষ ও দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। তিনি লিখেছিলেন, “আমার জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে আমি নিরুৎসাহ না হয়ে বিপুল উৎসাহ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি বাংলার দশ কোটি মা-বোন ও শিশুদের হাসি ফোটানোর জন্য। আমি চাই দেশে সমৃদ্ধি আসুক। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ উন্নত দেশরূপে পরিচিতি হোক। এটা আমার জীবনের একমাত্র কামনা।
আমাদেরও এই কামনা আমরা তাই চাই। তাই আপনাদের পথেই আমরা এগিয়ে চলেছি। আমাদের কর্ম, নিষ্ঠা, চিন্তা-ভাবনা, সাফল্য কোন কিছুই ভুলি নি আমরা।
(পুন: প্রকাশ)

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারী
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা