(দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)
বিমান বিক্রি করে দিয়ে উইলসন চলে গেলেন দার্জিলিং। সেখানে তিব্বতের দিক থেকে এভারেস্ট আরোহণের অনুমতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনদিক থেকেই সুবাতাস এলো না। শরৎ এবং শীতের পুরোটা সময় তিনি দার্জিলিং ছিলেন। আর আঁটতে থাকলেন ফন্দি। বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন যে তিনি এভারেস্ট আরোহণ পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। ১৯৩৪ সালে মার্চের এক ভোরে তিনি তিব্বতের লামার বেশভূষা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সাথে নিলেন ভূটিয়া গোত্রের তিনজন মালবাহক। সিকিম দিয়ে তিব্বতের লক্ষ্যে দ্রুতই শহরতলী থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাতের আঁধারে চলাচল করে মাত্র দশদিনেই পৌঁছে গেলেন তিব্বতের সীমান্তে। এলাকার উৎসুক জনতা গ্রামের বাইরে এক লামা আস্তানা গেঁড়েছেন জেনে উঁকিঝুঁকি মারলেও তিনি ছদ্মবেশ ধরে রাখলেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তাঁরা পৌঁছালেন এভারেস্ট বেসক্যাম্পের নিচে রংবুক মনাস্ট্রিতে।
ইতঃপূর্বে বিমান চালনার সময় তিনি যে উদ্দীপনা দেখিয়েছেন এখানেও এর ব্যত্যয় হলো না। ২১ এপ্রিল তাঁর জন্মদিন। ওই দিনেই এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে তিনি রংবুক হিমবাহে নেমে পড়লেন। এই বিস্তীর্ণ হিমবাহে বহুবার পথ ভুল করেও আরোহণ করে ফেলেন ৬,০০০ মিটার পর্যন্ত। পূর্ববর্তী ব্রিটিশ অভিযান ৬,৫০০ মিটার উচ্চতায় ক্যাম্প–৩ স্থাপন করেছিল। এর কাছাকাছি পৌঁছে তিনি মারাত্মক তুষারঝড়ের কবলে পড়লেন। উপায়ন্তর না দেখে নামতে শুরু করেন উইলসন। হিমবাহের বুকে তাঁবুতে আটকে থাকলেন দুদিন। একাকীই কেটে গেল তাঁর ৩৬তম জন্মদিন। তুষারপাত একটু কমে এলে তিন ফুট তাজা তুষারের স্তরের উপর দিয়ে ষোল ঘন্টার ক্লান্তিকর যাত্রা শেষে ফিরলেন মনাস্ট্রিতে।
মঠে ফিরে তিনি পরিকল্পনা পরিবর্তন করলেন। ক্যাম্প–৩ পর্যন্ত সঙ্গ দিতে তিনি দুই ভূটিয়াকে রাজি করিয়ে ফেললেন। ১২ মে এই তিনজনের দল মনাস্ট্রি ত্যাগ করলেন। এবার অগ্রযাত্রা আগের চেয়ে অনেক দ্রুত। উইলসনের রেখে যাওয়া রসদ পাওয়া গেল। কিন্তু চারপাশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও ক্র্যাম্পন জোড়ার হদিশ মিললো না। এই অবস্থাতেই নর্থ কোল এর কাছাকাছি আরোহণ করার পর আরো একবার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। এবার ২৯ মে তিনি একাই বেরিয়ে পড়লেন। যাত্রার আগে সঙ্গী দুই ভূটিয়াকে বলে গেলেন তাঁর জন্য ক্যাম্প–৩ এ দশদিন অপেক্ষা করতে। মরিস উইলসনকে এরপরে আর কখনো জীবিত দেখা যায়নি। পরের অভিযানে এরিক শিপটন এবং ডঃ চার্লস ওয়ারেন ব্রিটিশদের ক্যাম্প–৩ এর কাছেই তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পান।
একাকী মৃত্যুর কোলে ঢলে পরার আগে তিনি কতদূর অবধি আরোহণ করতে পেরেছিলেন তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে ধরেই নেওয়া যায় যে তিনি ৭,০১০ মিটার উচ্চতার নর্থ কোল অতিক্রম করেননি। কয়েকদিন আগে ভূটিয়াদের সাথে ক্যাম্প–৩ হতে নর্থ কোল এর দিকে খাড়া বরফের দেওয়াল আরোহনের সময় তাঁরা ফিরে এসেছিলেন। ক্র্যাম্পন হারানো উইলসন স্টেপ–কাটিং কৌশলের সাথেও সম্পূর্ণ রূপেই অপরিচিত ছিলেন। একটি অবশ বাহু নিয়ে কৌশলগত দিক হতে অদক্ষ, একাকী, কিন্তু ইচ্ছাশক্তিতে ভরপুর উইলসন সম্ভবত ওই বরফের দেওয়াল অতিক্রমের সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছিলেন। হয়তো ব্যর্থ হয়ে ক্যাম্প–৩ এ ফিরে এসে তিনি পোর্টারদের খুঁজে পাননি। কিন্তু খাবারে ভরপুর ক্যাম্প–৩ থেকে সামান্য দূরে স্লিপিং ব্যাগহীন অবস্থায় কেন পড়েছিলেন এই প্রশ্নের কোন যুতসই ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
আনকোরা উইলসনের চেষ্টা ছিল চমকপ্রদ। কিন্তু তাঁর ছুঁয়ে আসা শীর্ষবিন্দু সামসময়িকদের তুলনায় নগণ্য। ম্যালরি ১৯২১ সালে সহজেই নর্থ কোলে পৌঁছেন। পরের বছর জর্জ ফিঞ্চ ৮০০০ মিটার অতিক্রম করেন। ম্যালরি–আরভিন ১৯২৪ সালে আরো উঁচুতে পৌঁছান। অনেকের বিশ্বাস ঐবার তাঁরা শীর্ষে পৌঁছান এবং নেমে আসার সময় মৃত্যুবরণ করেন। দু:খজনকভাবে উইলসনের এই প্রথাবিরোধী অভিযান–এর খুঁটিনাটি খুব একটা আলোচনায় আসেনি পরবর্তীতে।
উইলসনের উদ্দেশ্য ও চরিত্র নিয়ে হাস্যকর, অপ্রাসঙ্গিক গুজব ও ভ্রান্ত ধারণা আজও ছড়িয়ে রয়েছে। উইকিপিডিয়ার এক স্থানে লেখা তিনি এই অভিযান করেছিলেন উপবাস ও প্রার্থনা সংক্রান্ত এক রহস্যময় ছদ্ম–ক্রিশ্চিয়ান মতবাদ প্রচারের জন্য। একজন সাংবাদিক প্রচার করেন যে উইলসন এভারেস্ট গেছেন যক্ষ্মা থেকে মুক্তি পেতে। এসব প্রচারণার কোন ভিত্তি পাওয়া যায়নি। আরেক স্থানে বলা আছে যে উইলসন মেয়েলী পোশাক পরিধান করতেন এবং আড়ালে লুকিয়ে রাখতেন নিজের যৌনজীবনের গোপন ডায়ারি। সত্য–মিথ্যা যাচাই না করেই বলা যায় এই তথ্য এভারেস্ট আরোহণের সাথে সম্পর্কহীন। এই ধারণাগুলো আসলে ছিল তখনকার পর্বতারোহণের দিকপালদের সৃষ্ট। তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে উইলসন আসলে এক অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তি, যে বেপরোয়াভাবে সত্যিকারের সাহসীদের এক খেলাতে অংশ নিতে চেয়েছিল। আল্পাইন ক্লাবের কর্তারা উইলসনের অতীত সম্পর্কে কাল্পনিক বর্ণনার মাধ্যমে নিজেদের মতবাদকে স্থায়ী রূপদানের সুক্ষ্ম চেষ্টায় কোনই কার্পণ্য করেননি।
উইলসন ছিলেন একজন অনভিজ্ঞ পর্বতারোহী এবং এভারেস্ট আরোহণের জন্য অপ্রস্তুত। কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণেই উইলসন হাস্যস্পদে পরিণত হবেন? ইংল্যান্ড থেকে ভারত পর্যন্ত বিমান চালনা প্রমাণ করে যে তিনি শুধুমাত্র অসম্ভব রকমের সাহসী মানুষই ছিলেন না বরং জটিল কৌশল দ্রুত রপ্ত করতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এছাড়াও দার্জিলিঙের দিনগুলোতে তিনি পূর্ববর্তী ব্রিটিশ অভিযানে অংশ নেওয়া স্থানীয়দের কাছ থেকে উপদেশ এবং প্রশিক্ষণ নিতেন। আল্পাইন ক্লাবের সহযোগিতা ছাড়াই তিনি সকল প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করেন। এমনকি আগের ব্র্রিটিশ এভারেস্ট অভিযান থেকে চুরি হওয়া অতি–উচ্চতায় ব্যবহার উপযোগী একটি তাঁবুও জোগাড় করে ফেলেন। একাকী এভারেস্ট আরোহণের পরিকল্পনা ছিল খ্যাপাটে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে ভ্রান্ত প্রচারণার একমাত্র কারণ ছিল কর্তারা চাইতেন পৃথিবীর শীর্ষ পর্বত আরোহণ করতে হবে জাতীয়ভাবে এবং জাতীয় গৌরবের জন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায় জাতীয় জাঁকজমকের গৌরব এবং যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে টিকে থাকার মোহ। এর পরিবর্তে খেলাধুলাই পরিণত হয় জাতিগত প্রতিযোগিতার প্রধান ক্ষেত্র। পর্বতারোহণ নামক সবচেয়ে বিপদজ্জনক খেলা ছিনতাই হয়ে যায় আধুনিক জাতীয়তাবোধের হাতে।
উইলসনই ছিলেন হিমালয়ের চূড়ার দিকে একাকী যাত্রা করা প্রথম মানুষ। তাঁর ছিল না পর্বতারোহণ সাম্রাজ্যের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা, না ছিল সামরিক বাহিনীর সার্বিক সহায়তা। জাতীয় পতাকা নয়, তাঁকে উদ্দীপ্ত করেছে এর চেয়েও অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী কোন অনুভূতি। এতো বাধা পেরিয়ে ভারতবর্ষে উড়ে যাওয়া, এভারেস্ট বেসক্যাম্পে পৌঁছা, চূড়ায় আরোহণের চেষ্টা, উইলসনের অবিচল মানসিক দৃঢ়তারই পরিচায়ক। পর্বতারোহণের মূল গুণাবলি হিসেবে বিবেচ্য সব গুণই ছিল তাঁর। অভাব ছিল শুধু পর্বতারোহণ দক্ষতার।
বেশকিছু সুপরিচিত পর্বতারোহীর মুখে বিভিন্ন সময় শোনা গেছে উইলসন–স্তুুতি। উইলসনের দেহ এবং ডায়েরি উদ্ধারের পর এরিক শিপটন বলেন যে ওই রোজনামচার প্রতি পাতায় ছড়ানো দৃঢ় প্রত্যয়, প্রকৃতির জন্য ভালোবাসা এবং ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সকল প্রতিকূলতা জয় করার মানসিকতা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। ১৯৮০ সালে প্রথম মানব হিসেবে একাকী এভারেস্ট আরোহণ করেন রেইনহোল্ড মেসনার। অভিযানে ৮,০০০ মিটারে তাঁবু স্থাপনের সময় নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কে বড় পাগল? তিনি নিজে নাকি উইলসন?