স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুর জাহান বেগম বলেছেন, আমি দেখেছি ডাক্তারকে সিটি এলাকার বাইরে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। অনেকে সিটির বাইরে একদিন যান, ডিজিটালি একটা উপস্থিতি দেন, দুই ঘণ্টা বাদে চলে আসেন। এগুলো সব খবর নিচ্ছি, আমি চলে যাওয়ার আগে এগুলোর ব্যবস্থা করে যাবো। এছাড়া আপনাদের (ডাক্তারদের) রুম হয়েছে, নার্সদের রুম হয়েছে। আমি আপনাদের অনুরোধ করব, এ জায়গাগুলোকে কখনও পার্টির অফিস বানিয়ে ফেলবেন না। এটা পার্টির জায়গা না, এটা দলের জায়গা না। এটা চিকিৎসার জায়গা। আলোচনা করে চিকিৎসার সমস্যা সমাধানের জায়গা। আপনারা সরকারের থেকে বেতন নেন। সে বেতনটাকে জায়েজ করে নিতে হবে।
গতকাল সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নতুন ক্যাথল্যাব এবং সিসিইউ আধুনিকীকরণ কাজের উদ্বোধন শেষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। হাসপাতালের সম্মেলন কক্ষে বিভিন্ন চলমান উন্নয়ন প্রকল্প ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার বিষয়ে এ মতবিনিময় সভাটি অনর্ুষ্ঠিত হয়। এর আগে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এমবিবিএস ও বিডিএস এর ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, সভায় অনেকগুলো সমস্যার কথা উঠে আসছে। তবে আমি বলতে চাই– হৃদরোগ বিভাগে যে একটি ক্যাথল্যাব (এনজিওগ্রাম) মেশিন আছে, ওই মেশিনে হৃদরোগ বিভাগ, নিউরোলজি বিভাগ এবং নিউরো সার্জারি বিভাগের ভাগ করে কাজ করতে হবে। সেভাবে আপনারা নিজেরাই ডিউটি রোস্টার (কর্তব্য পালনের তালিকা) বানিয়ে নেন। আপাতত একটা দিয়ে চালাতে হবে। তবে আমি চেষ্টা করব নতুন আরেকটা মেশিন দিতে। জানি না সময় পাওয়া যাবে কিনা, কারণ সামনে নির্বাচন। হাতে সময় কম। আরকটি বিষয় হচ্ছে–স্বাস্থ্যের এমন কোনো টাকা নাই, যেখান থেকে আমরা দিতে পারি। আমাদের মোট ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার দরকার ছিল বিভিন্ন যন্ত্রপাতির কেনার জন্য। কিন্তু সেটাও আমরা অনুমোদন পাইনি। স্বাস্থ্যের টাকা কিন্তু থেকে যায়, কেন থাকে, প্রপার বাজেটটা হয় না। উন্নয়ন বাজেটে টাকা আছে ৮ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়নের বাজেট বড়, তাই আমরা যদি প্রতি তিন বছরের জন্য বাজেট করে রাখি, তাহলে কিন্তু হয়। এছাড়া এখন উন্নয়ন বাজেটে অত টাকা না রেখে যদি আমাদের মূলধনী বাজেটে রাখি, তবে আমরা যন্ত্রপাতির সমস্যার সমাধান করতে পারতাম।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা আরো বলেন, হৃদরোগ বিভাগের সিসিইউ আধুনিকায়নে শাহেনশাহ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ট্রাস্ট এগিয়ে এসেছে। এ রকম চট্টগ্রামে আরো অনেক ধনী লোকজন আছেন। যাদের কাছ থেকে আপনারা সাহায্য সহযোগিতা নিতে পারেন। আপনারা জানেন, ক্রাউড ফান্ড দিয়ে অনেক সময় অনেক কিছু হয়। নিউরোলজি বিভাগের ডাক্তার সাহেব বলছেন, ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসে (নিনস) ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজিতে ট্রেনিংয়ের বিষয়ে। এটি তো কমার্শিয়াল ট্রেনিং না। কাজে এখনই আপনারা নাম পাঠান। তবে এখানে একটা কথা আছে। ডাক্তারদের মধ্যে যারা সিটি ছাড়তে চান না বলে, তারা এসব ট্রেনিং পোস্টে যেতে চান। ওই রকমের লোক দিবেন না। যারা দীর্ঘদিন পেরিফেরিতে (প্রত্যন্ত এলাকা) কাজ করে আসছে, ওদেরকে সিলেক্ট করবেন। যদি ওই ধরনের কেউ থাকে, বয়স কম, এই সাবজেক্টে কাজ করার আগ্রহ আছে, আমরা তাদের দেখব। এখন আমরা ব্যক্তিগত ইনকাম করব, আমাদের চেম্বার এখানে থাকবে, আমরা চেম্বার ছেড়ে বাইরে কোথাও যাব না, সে কারণে আমাকে এখানে থাকতে হবে, অনেকে কিন্তু এই ধারণাও পোষণ করেন। সুতরাং এটি মাথায় রাখবেন। আরেকটা কথা বলি– এবার কিন্তু অনেকে বদলি হয়ে যাবেন। এবার আমরা প্রমোশনে পোস্টিংটা দিবো, অটোমেশনের মাধ্যমে। যারা দীর্ঘদিন গ্রামে কাজ করেছেন তারা সেন্টারে আসার প্রথম চান্সটা পাবেন। আমি চাচ্ছি এখানে কোনো ধরনের বৈষম্য যেন না থাকে।
নুর জাহান বেগম বলেন, আপনারা পেরিফেরির নার্সগুলো নিয়ে আসতে বলেন। তাহলে পেরিফেরারি মানুষ কোথায় যাবে, ওরা কোথায় ট্রিটমেন্ট নেবে। চিটাগংয়ের কথা বলছেন, আপনারা এখানে মেয়েদেরকে নার্সিং পড়ান না কেন, ছেলেদেরকে নার্সিং পড়ান না কেন। আপনার জন্য কেন দিনাজপুর থেকে নার্স এসে কঙবাজারে চাকরি করবে, টেকনাফে চাকরি করবে। কিংবা চট্টগ্রামে কত বছর কাজ করবে, কত বছর থাকবে। আপনারা সবাই ছেলে মেয়েদের শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনারেল লাইনে পড়াচ্ছেন। এইসব লাইনে দিচ্ছেন না কেন? এখানে পড়লেই তো চাকরি। জাপান ও যুক্তরাজ্য লাখ লাখ কেয়ার গিভার নিয়ে যাবে, নার্সিং এটাতো ভোকেশনাল ট্রেনিং। আপনারা নার্স তৈরি না করলে নার্স পাবেন না। কারণ আমি যখন দিনাজপুরের মেয়ের কান্না শুনি, আমার নিজের কাছে ভালো লাগে না। কারণ সে কেন আপনার জন্য এত বছর এখানে কাজ করবে। আপনারা কনজারভেটিভ হয়ে থাকবেন, আপনাদের ছেলে মেয়েদেরকে আপনারা নার্সিংয়ে পড়াবেন না। এটা প্রেস্টিজে লাগে কেন, নার্সের কাজ কি প্রেস্টিজে লাগার মত কাজ? আমরা ডাক্তার বানাচ্ছি এখন ৭০ শতাংশ মহিলা ডাক্তার হয়ে গেছে, কিন্তু মেয়েরা আবার পেরিফেরিতে যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, আমি জানতে পারলাম, চট্টগ্রাম মেডিকেলের একটি এমআরআই মেশিন মেরামতের জন্য তিন বছর ধরে মন্ত্রণালয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শুধু চিঠি লিখেছে। আসলে এটি আমাদের সিস্টেমের দোষ। কাউকে আমি কোনো দোষ দিচ্ছি না। এখানে দেখা যায়, চিঠি সচিবের টেবিলে পড়ে থাকে। অনেক সময় এত কাগজের ভিতরে এগুলা চোখেই পড়ে না। কাজেই যেখানে নক করা দরকার, সেই জায়গায় নক করতে হবে। সে সচিব, সে মন্ত্রী, সে উপমন্ত্রী ডোন্ট বদার ফর দ্যাট। অনেক সময় আমি শুনি যে আমি, সরাসরি আপনাকে দিতে পারবো? এটা পারার কি আছে, আসলে মন্ত্রণালয়ে কাজের পিছনে লাগতে হয়। আঠার মত লেগে থাকতে হবে। এই যে এমআরআই মেশিনের জন্য ৪০ টা চিঠি দেওয়া হয়েছে, একটা বা দুইটার পর ধরতে হবে। আদায় করতে হবে। দরজা বন্ধ থাকলে দরজা খুলতে হবে। তবে অভদ্র ভাষায় না।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীনের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে হৃদরোগ বিভাগের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড এবং সফলতা তুলে ধরেন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আনিসুল আউয়াল। একই সাথে তিনি অনুষ্ঠান সঞ্চালনাও করেন। পরবর্তীতে হৃদরোগ বিভাগের বিভিন্ন সমস্যার বিষয় তুলে ধরেন সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. নুর উদ্দিন তারেক। এছাড়া নিউরোলজি বিভাগের নানা সমস্যার কথা তুলে বক্তব্য রাখেন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাসানুজ্জামান। পরবর্তীতে স্বাস্থ্যখাতে শাহেন শাহ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী ট্রাস্টের বিভিন্ন অবদান তুলে ধরেন ডা. সামিউল করিম। এছাড়া ট্রাস্টের সচিব অধ্যাপক এ ওয়াই এমডি জাফর এবং গোঁয়াছি বাগানে চলমান বার্ন হাসপাতালের অগ্রগতি তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক এবং চমেক হাসপাতাল বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিক উদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার একান্ত সচিব ড. মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ইসলাম, চমেক হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসক এবং শাহেন শাহ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ট্রাস্টের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।












