ডলারের বিপরীতে ব্যাংকে টাকার বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ায় হুন্ডির দাপট কমতে শুরু করেছে। ব্যাংকের মাধ্যমে বাড়ছে রেমিটেন্স প্রবাহ। ঈদকে সামনে রেখে চলতি মাসের প্রথম বিশ দিনে অন্তত ১৪ হাজার কোটি টাকা দেশে এসেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র গতকাল জানিয়েছে। আগের মাসে একই সময়ে দেশে এসেছিল ১২ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। অপরদিকে ঢাকা জেলার পরে চট্টগ্রাম জেলায় সর্বাধিক রেমিটেন্স আসে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র বলেছে, আসন্ন কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে প্রবাসীরা দেশে বিপুল পরিমাণ টাকা পাঠাচ্ছেন। ব্যাংক রেট ভালো থাকায় প্রবাসীরা হুন্ডির পরিবর্তে ব্যাংকে টাকা পাঠাতে উৎসাহি হয়েছেন। ব্যাংকিং চ্যানেল টাকা আসার ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রায় তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
সরকার সম্প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার পুনর্নির্ধারণ করেছে। টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের ফলে আগে প্রতি ডলারের বিপরীতে ব্যাংক রেট ১১০ টাকা থাকলেও তা বেড়ে ১১৭ টাকা হয়েছে। এর বাইরে রেমিটেন্সের প্রনোদনার ফলে হুন্ডিতে পাঠালে প্রবাসীরা যে টাকা পেতেন তা ব্যাংক থেকেই পাচ্ছেন। এতে করে ঝুঁকি নিয়ে হুন্ডিতে টাকা না পাঠিয়ে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে শুরু করেছেন। যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। চলতি মে মাসের প্রথম বিশ দিনে দেশে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে আসার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদস্থ একজন কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন, আগের চেয়ে প্রবাহ বেড়েছে। এটি টাকার অবমূল্যায়নের ফল বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
চট্টগ্রামের বেসরকারি ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপক জানান, ঈদকে সামনে রেখে প্রবাসীদের রেমিটেন্স পাঠানো বেড়েছে। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে পশু কেনাসহ নানা ধরণের খরচের জন্য প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। প্রবাসী পরিবারগুলোর এই অর্থের উৎস হচ্ছে বিদেশী টাকা। যা ইতোমধ্যে আসতে শুরু করেছে। প্রবাসীরা স্বজনদের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন। আশার কথা হচ্ছে ইতোপূর্বে এসব টাকার একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসতো। ব্যাংক থেকে হুন্ডিতে বেশি টাকা পাওয়ার ফলে অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে অপরিচিত মানুষের হাতে টাকা তুলে দিতেন। যারা প্রবাসী পরিবারগুলোর আত্মীয় স্বজনদের হাতে টাকা পৌঁছে দেন। কিন্তু সাম্প্রতিক ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে ব্যাংক থেকেও প্রায় হুন্ডির সমান টাকা পাওয়া যাচ্ছে। এতে করে প্রবাসীরা আর হুন্ডিতে টাকা না পাঠিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। যা ইনকাম ট্যাঙসহ নানা ক্ষেত্রে সাদা টাকা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। হুন্ডির টাকা পুরোটাই কালো টাকায় পরিণত হয়। প্রবাসীদের বিনিয়োগসহ নানা ক্ষেত্রে হুন্ডির মাধ্যমে আসা কালো টাকা বড় ধরণের সংকট সৃষ্টি করে। এসব সংকট থেকে বাঁচতেও প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর দিকে ঝুঁকছেন।
সূত্র বলেছে, হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে না। শুধু ম্যাসেজ বা ফোনকল আদান প্রদান হয়। দেশীয় টাকা দিয়ে হুন্ডির টাকা পরিশোধ করা হয়। হুন্ডিওয়ালারা বৈদেশিক মুদ্রাগুলো বিদেশেই রেখে দেয়। বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই বিদেশে থেকে যাওয়ায় সেটা আর দেশের কোন কাজে লাগে না। স্বর্ণ চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অবৈধ কাজে হুন্ডির টাকা ব্যবহৃত হয়। সরকার ২.৫ শতাংশ প্রনোদনা দিয়ে প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু হুন্ডিওয়ালারা সরকারের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিনিময় হার আরো বাড়িয়ে দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে বিনিময় হার বাড়ার পাশাপাশি আড়াই শতাংশ প্রনোদনা পাওয়ার ফলে খোলা বাজারে ডলার যে দরে বিক্রি হচ্ছে ঠিক তার কাছাকাছি দর পাওয়া যাচ্ছে ব্যাংক থেকে। ফলে হুন্ডির দাপট কমতে শুরু করেছে বলে মন্তব্য করেন একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপক। তবে খোলা বাজারে বা হুন্ডিতে ডলারের বিনিময় হার আরো বেড়ে গেলে পরিস্থিতি উল্টে যেতে পারে বলেও তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, দেশের স্বার্থেই হুন্ডি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন জরুরি। হুন্ডির টাকা দেশের কোন কাজে আসে না। অপরদিকে প্রবাসীদের আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবেশ করলে তা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নসহ নানা ক্ষেত্রে বড় ধরণের ভূমিকা রাখে। বর্তমানে বছরে গড়ে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ রেমিটেন্স হিসেবে আসে। যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করে।
অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক একটি হিসেবের উদ্বৃতি দিয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, দেশে রেমিটেন্স প্রবাহে ঢাকার পরে চট্টগ্রাম জেলার অবস্থান।
গত বছরের জুলাই থেকে গত মাসের শেষদিন পর্যন্ত প্রবাসীরা দেশে এক হাজার ৯১১ কোটি ৭৩ লাখ ডলার প্রেরণ করেছেন। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় এসেছে ৬৬২ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। চট্টগ্রাম জেলায় প্রবাসী আয় এসেছে ১৮৬ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। এছাড়া কুমিল্লা জেলায় ১০১ কোটি ৯০ লাখ ডলার, নোয়াখালীতে ৬০ কোটি ২০ লাখ ডলার, ফেনীতে ৪৮ কোটি ৪৬ লাখ ডলার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪৮ কোটি ২৫ লাখ ডলার এবং চাঁদপুরে ৪৫ কোটি ৪৮ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছে। রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে বিরাজমান সংকট ঘুচে যাবে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।