ঠিক যেন পা সিনেমার ‘অমিতাভ বচ্চন’

মা-বাবার আশা, ১০ বছরের শাহাদাতের জীবনের চাকা ঘুরবে কারো সহায়তায়

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ১০ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

অমিতাভ বচ্চনের আলোচিত সিনেমা ‘পা’ এর অরো’র মতো একটি শিশুর হদিস মিলেছে মীরসরাইয়ে। বিরল রোগ প্রোজেরিয়া’য় আক্রান্ত দশ বছরের শিশু শাহাদাত হোসেনকে আশি বছরের বৃদ্ধের মতো লাগে।

২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া হিন্দি সিনেমা ‘পা’ তে পরিচালক বাল্কি ভিন্ন ধারার একটি চরিত্রের চিত্রায়ন করে। দর্শকপ্রিয় বহুল আলোচিত ওই সিমেনায় বিগ ভি অমিতাভ বচ্চন ‘অরো’ নামে একটি শিশুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। অরো প্রোজেরিয়ায় ভুগছিল। প্রোজেরিয়া এমন একটি জিনগত রোগ যাতে আক্রান্ত হওয়া শিশু খুবই অল্পবয়সেই বার্ধক্যের অবয়বে পৌঁছে যায়। অর্থাৎ পাঁচ সাত বা দশ বছরের একটি শিশুকে সত্তর আশি বছরের বৃদ্ধের মতো দেখা যায়।

পা সিনেমাতে অমিতাভপুত্র অভিষেক বচ্চন শিশুটির পিতার ভূমিকায় অভিনয় করেন। আর শিশুটির চরিত্রে অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন। ছবিতে শিশুটির নাম অমিতাভ হলেও তাকে অরো নামে ডাকা হতো। সিনেমায় ১২ বছর বয়সী অরো খুবই বুদ্ধিমান ছিল। তাকে ওই ১২ বছর বয়সে ৬০ বছর বয়সী মানুষের মতো দেখাচ্ছিল। অরো তার মা’ বাবা ছাড়াও সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলাসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করে। সবার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠে। মীরসরাইয়ে প্রোজেরিয়া আক্রান্ত শিশু শাহাদাতও লেখাপড়া করে। করে খেলাধুলাও। কিন্তু এসব আনন্দের সাথে সে করতে পারে না। করে একা একা। বাড়ির কাছের স্কুলে তাকে ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। একটি মাদ্রাসায় দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল সেখানেও তার ঠাঁই হয়নি। স্কুল এবং মাদ্রাসা প্রধানের যুক্তি ছিল এই শিশুকে দেখলে অন্য শিশুরা ভয় পাবে। তাই বাড়ি থেকে অন্তত তিন কিলোমিটার দূরে মীরসরাইর মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শাহাদাতকে ভর্তি করানো হয়। সেখানে সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার চেহারা আশি বছরের বৃদ্ধের মতো হলেও গলার স্বর একেবারে শিশুর মতো। ক্লাসের অন্য ছেলেরা তাকে এড়িয়ে চলে। পাড়ায়ও তার তেমন কোন বন্ধু নেই। পিতার কিনে দেয়া একটি সাইকেলই শাহাদাতের সঙ্গী। সাইকেলটি নিয়ে সে নিজের মতো মেতে থাকে। পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, ১০ বছরের শাহাদাতকে দেখতে আশি বছরের বৃদ্ধের মতো মনে হয়। তার বয়স যখন মাত্র ৭ মাস তখন থেকে তার শরীরে বার্ধ্যকের ছাপ পড়তে শুরু করে। এরপর থেকে তার বয়স যত বাড়তে থাকে তার চেহারায় বার্ধক্যের ছাপও তত বাড়তে থাকে। শাহাদাতের বাবা মোহাম্মদ হানিফ রিঙা চালায়, মা নাসিমা আকতার গৃহিনী। হানিফ এবং নাসিমার সংসারে আরো দুইটি কন্যা সন্তান রয়েছে। দুই কন্যা সন্তানের পর একটি পুত্র সন্তান পেয়ে হানিফনাসিমা দম্পতি হাতে আকাশের ছাদ পেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই আনন্দ মিইয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি।

শাহাদাত জন্ম নেয় ২০১৪ সালে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে তার জন্ম হয়। তাকে নিয়ে ঘরে ফিরলেও সাত মাসের মাথায় আবারো হাজির হতে হয় চমেক হাসপাতালে। শিশুর শরীরে চামড়া কুকড়ে যাওয়ায় তাকে এনে ডাক্তার দেখানো হয়। ওই সময় ১ মাস ১৩ দিন তারা হাসপাতালে ছিল বলে দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন শিশুটির বাবা রিকশা চালক মোহাম্মদ হানিফ। কিন্তু চিকিৎসকেরা সব আশা ছেড়ে দিয়েছেন। বলেছেন শাহাদাত বিরল প্রোজেরিয়া রোগে আক্রান্ত। এই রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশভারতে নেই। শুধু আমেরিকায় এই রোগের চিকিৎসা রয়েছে। কিন্তু রিকশা চালক হানিফের পক্ষে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে প্রিয় সন্তানের চিকিৎসা করানোর কথা স্বপ্নে কল্পনা করারও সাধ্য নেই।

ভূমিহীন রিকশা চালক মোহাম্মদ হানিফের নিজের বলতে কিচ্ছু নেই। এমনকি রিকশাটিও তার নিজের নয়। জায়গা জমি কিছু নেই, নেই ঘর ভিটাও। রাস্তার পাশে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ছোট্ট একটি জায়গায় কোনরকমে একটি একচালা ঘর তৈরি করে তাতে দুই মেয়ে এবং শাহাদাতকে নিয়ে বসবাস করেন হানিফ।

শাহাদাতের বর্তমান অবস্থা বলতে গিয়ে মোহাম্মদ হানিফ জানান, ১০ বছরের শাহাদাতের গায়ের চামড়া কুকড়ে গেছে। মুখমণ্ডলে আশি বছরের বৃদ্ধের ছাপ। তিন ফুটের সামান্য বেশি উচ্চতার শাহদাতের মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে। কয়েকটি দাঁত নড়ছে। যখন তখন পড়ে যাবে। হাতপায়ে ব্যাথা হয়, শিরা ফুলে গেছে। মুখের বিভিন্ন অংশ ঝুলে গেছে, চোয়াল, কপাল এবং কানের চামড়া ঝুলে পড়েছে। শাহাদাতের বহু রকমের কষ্ট বলে উল্লেখ করে মোহাম্মদ হানিফ জানান, সে রাতে ঘুমাতে পারে না। সে কিছু খেতে পারে না বলে উল্লেখ করে মোহাম্মদ হানিফ জানান, বিভিন্ন ফলমূলই তার খাবার। কিন্তু আমরা এত গরিব যে ঠিকভাবে ভাত জোটানো যেখানে কঠিন, সেখানে ফলমূল কেনা সম্ভব হয় না।

একাধিক চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রোজেরিয়া রোগে আক্রান্ত শিশু ৭ থেকে ২০ বছরের বেশি বাঁচে না। খুবই অল্পবয়সে তাদের শরীরে বার্ধক্যের ছাপ চলে আসে। তাদের হার্ট, কিডনি, লিভার এগুলো দ্রুত কর্মক্ষমতা হারায়। ফলে অল্পবয়সেই শিশুটি মারা যায়।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জেসমিন বেগম গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রোজেরিয়া একটি বিরল রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হলে একটি শিশু খুব দ্রুতই বুড়ো হয়ে যায় এবং বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশুটি মারা যায়। এই রোগে আক্রান্ত শিশু ২০/২১ বছরের বেশি বাঁচার রেকর্ড নেই বলেও ডা. জেসমিন উল্লেখ করেন। রোগটিকে একেবারে বিরল বলে উল্লেখ করে ডা. জেসমিন বলেন, আশি লাখ শিশুর মধ্যে এই রোগ নিয়ে জন্মাতে পারে একটি শিশু। অর্থাৎ প্রতি আশি লাখে একজন। জিনগত প্রভাব থেকে এই রোগ হতে পারে বলে মন্তব্য করে ডা. জেসমিন বলেন, এই রোগ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। এই রোগ কেন হচ্ছে সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। জিনগত সমস্যার কারণে হচ্ছে বলা হলেও বেশি বয়সী বাবার ক্ষেত্রে জন্ম নেয়া শিশু এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কিছুটা ঝুঁকি থাকে বলেও বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। ডা. জেসমিন কখনো এই রোগাক্রান্ত কোন শিশুর চিকিৎসা করান নি বা দেখেন নি বলে জানান।

পিতা হানিফ এবং মা নাসিমার বুকের ভিতরে শিশু শাহাদাতের জন্য নিত্য হাহাকার। ‘পা’ সিনেমার অরো’র কোনো অভাব ছিল না, কিন্তু বাস্তবের শাহাদাত থাকে নিত্য অভাবে। তার খাবার জুটে না, খেলনা জুটে না, জুটে না চিকিৎসা। চারদিকের এতো অভাবের মাঝে হানিফ পরিবারের আশা শাহাদাতের জীবনের চাকা হয়তো কারো বদান্যতায় ঘুরে যাবে। সরকার কিংবা কোন বিত্তবানের সহায়তায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে নিরন্তর ছুটে চলা শাহাদাতকে তার পিতা মাতা বাঁচানোর স্বপ্ন দেখছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচমেক হাসপাতালে শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে মারধরের অভিযোগ
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে, খালেদা জিয়াও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন : তথ্যমন্ত্রী