চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২৬০ কোটি ৮৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকার একটি প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ‘অনিয়ম’ এর অভিযোগ উঠেছে। যা ‘গোপন’ করতে প্রকল্প পরিচালক পিপিআর লঙ্ঘন করেছেন। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয় প্রকল্প পরিচালক ও চসিকের বিদ্যুৎ শাখার এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে। প্রকল্পটির দরপত্র কার্যক্রমে অংশ নেয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে দেশের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শর্ট লিস্ট করা হয়। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন একই ব্যক্তি। যা নিয়মবহির্র্ভূত।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় ঋণ সহায়তা প্রকল্পের অধীনে ‘মর্ডানাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্স এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ শীর্ষক এলইডি বাতি স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১৯ সালের ৯ জুলাই প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। ২০২১ সালের নভেম্বর মাস থেকে প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখনো ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়নি। প্রকল্পটির পরিচালক চসিকের বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অ. দা) ঝুলন কুমার দাশ।
জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী ভারতের এক্সিম ব্যাংক তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শর্ট লিস্ট পাঠায়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- ‘এনার্জি ইফিসিয়েন্সি সার্ভিসেস লিমিটেড’, ‘সিগনিফাই ইনোভেশন্স ইন্ডিয়া লিমিটেড’ এবং ‘শাপর্জি পালনজি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড’। একইভাবে বাংলাদেশের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয় প্রকল্পের জন্য। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- ‘ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেড’, ‘এইচটিএমএস লিমিটেড’ ও ‘ফটো স্টার লিমিটেড’। শর্ট লিস্টের প্রতিষ্ঠানগুলোয় দরপত্রে অংশ নেয়। বাছাই শেষে ভারতীয় একটি ও বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করা হবে। যারা যৌথভাবে কাজ করবে।
একই ব্যক্তির সম্পৃক্ততা দুই প্রতিষ্ঠানে: নিয়ম অনুযায়ী একই ব্যক্তির মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না। তবে শর্ট লিস্টে থাকা বাংলাদেশের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেড ও এইচটিএমএস লিমিটেড এর সঙ্গে একই ব্যক্তির সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চসিকের বিভিন্ন নথিপত্রে এইচটিএমএস লিমিটেড এর পরিচালক হিসেবে প্রকৌশলী মো. মাহবুব হোসাইন এর নাম রয়েছে। আবার ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও তার নাম রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের জানুয়ারি মাসে একটা বই বিতরণ অনুষ্ঠানে উদ্বোধক ছিলেন প্রকৌশলী মাহবুব হোসাইন। সেখানে মঞ্চের ব্যানারে তার পদবী লেখা হয় ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ওই অনুষ্ঠান উপস্থিত এবং আয়োজকদের একজন ছিলেন প্রকল্পটির পরিচালক প্রকৌশলী (অ.দা) ঝুলন কুমার দাশ। আবার চসিকের জাইকার অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন একটি প্রকল্পের ঠিকদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে এইচটিএমএস লিমিটেড। সেখানে নথিপত্রে পরিচালক হিসেবে নাম আছে প্রকৌশলী মাহবুব হোসাইন এর। তাছাড়া প্রতিষ্ঠান দুটো যে কাজের যে অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে তা এখনো চলমান। অথচ কাজ শেষ হওয়ার আগে অভিজ্ঞতা সনদ দেয়া হয় না।
জানা গেছে, জাইকার অর্থায়নে চসিকের যে প্রকল্পে এইচটিএমএস লিমিটেড কাজ করছে সে কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই প্রতিষ্ঠানটির স্থাপিত জিআই পোল এ জং ধরে। বিষয়টি নিয়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত চসিকের সাধারণ সভায় প্রশ্ন উঠে। এরপর অনিয়ম খুঁজতে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন মেয়র।
এ বিষয়ে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, একই ব্যক্তির দুটি প্রতিষ্ঠান থাকার বিষয়টি শুনেছি। সেটা আমরা অফিসিয়ালি যাচাই-বাছাই করে দেখছি। কাগজপত্রগুলো যাচাই-বাছাই শেষে আসল সত্য জানতে পারবো। এ প্রকৌশলী বলেন, পিপিআর ২০০৮ অনুযায়ী একই ব্যক্তির একাধিক প্রতিষ্ঠান একই দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না। সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রক্রিয়া চলছে। গঠন করা হবে।
অতঃপর কারণ দর্শানো : গত ২৩ জানুয়ারি কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয় বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অ.দা) ঝুলন কুমার দাশকে। প্রধান প্রকৌশলী স্বাক্ষরিত এ নোটিশ সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় ঋণ সহায়তার প্রকল্পটির দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর। দরপত্র দাখিলের সর্বশেষ দিন নির্ধারণ করা হয় ১৪ ডিসেম্বর। দরপত্র দাতাগণের দাখিলকৃত কারিগরী ও আর্থিক প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ের লক্ষে পিপিআর-২০০৮ এর বিধি-৮ উপ-বিধি (১), (৩) মোতাবেক দরপত্র উন্মুক্তের পূর্বে আনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক (আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশ অনুযায়ী) দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি) গঠন করার বিধান রয়েছে। প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও অনুরূপ কোন প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ)। এতে প্রকল্পের কারিগরী ও আর্থিক প্রস্তাবনা মূল্যায়নে জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং পিপিআর বিধি লঙ্ঘন হয়েছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়। এমনকি দরপত্র উন্মুক্ত করণ কমিটি (টিওসি) গঠনের প্রস্তাবনাও নথিতে উপস্থাপন করেনি বলে নোটিশে উল্লেখ রয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, গত ১৭ জানুয়ারি প্রকল্পের মূল নথি নিজের হেফাজতে রেখে খন্ড নথির মাধ্যমে নথির কার্যক্রম প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে উপস্থাপন করেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ)। খন্ড নথি মেয়র এর অনুমোদনের পর প্রধান প্রকৌশলীকে অবহিত না করে তা পুনরায় নিজ হেফাজতে নিয়ে যান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ)। এতে নথির কোন বিষয় ‘গোপন’ রাখা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
এদিকে গত মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে নোটিশের জবাব দেন ঝুলন কুমার দাশ। এতে তিনি দাবি করেন, গোপন রাখার বিষয়টি সত্য নয়। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কর্পোরেশনের নথি যথাসময়ে সংরক্ষণ ও যথাসময়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। জবাবে বলা হয়, দরপত্র দাখিলের পূর্বে প্রকল্প পরিচালক হিসাব প্রস্তাব করলে মেয়র কমিটি গঠন ও অনুমোদন প্রদান করলে যথাযথভাবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহে অবহিত করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে উক্ত নথি চলমান থাকায় প্রকল্প সংক্রান্ত সকল তথ্য সমেত উক্ত নথি হতে যেকোন তথ্য মিস হতে পারে বিধায় প্রধান প্রকৌশলীকে সশরীরে প্রদর্শন ও অবহিতকরণপূর্বক মূল নথির রেফারেন্স খন্ড নথি উপস্থাপন করা হয়। তাছাড়া বিগত ১৯ জানুয়ারি পুনঃগঠিত কমিটি মেয়রের অনুমোদন শেষে কমিটি প্রেরণ সংক্রান্ত সংযুক্ত পত্রে স্বাক্ষর নিতে প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে গেলেও দপ্তর বন্ধ থাকায় স্বাক্ষর গ্রহণ সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অ.দা) ঝুলন কুমার দাশ দৈনিক আজাদীকে বলেন, কিছু কোয়ারি চেয়েছিলেন। যা যা জানতে চেয়েছেন তা দেখিয়েছি। প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, জবাব সন্তোষজনক ছিল না।