ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত তিন তরুণের বাড়িতে শোকের মাতম

মীরসরাইয়ে সোনাপাহাড়

মাহবুব পলাশ, মীরসরাই | শনিবার , ২১ জুন, ২০২৫ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

মীরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাপাহাড় এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত তিন তরুণের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল শুক্রবার দিনভর কান্না আর আহাজারিতে সোনাপাহাড় গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে যেন শোকের ছায়া। একই গ্রামে বাড়ি তিন তরুণের। তিনজনই ছিলেন বন্ধু। কাজও করতেন একই কারখানায়। আর একসঙ্গেই মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। তাদের এমন মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে গ্রামটিতে। বৃহস্পতিবার রাতে জোরারগঞ্জের সোনাপাহাড় এলাকায় আরশিনগর ফিউচার পার্ক বিনোদন কেন্দ্রের পেছনে ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হন তিন তরুণ। তারা হলেন, দিদারুল আলমের ছেলে মো. আরাফাত (১৮), আবু তাহেরের ছেলে মো. আনিস (১৮) ও জিয়াউর রহমানের ছেলে মো. রিয়াজ (১৮)। বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে নিহতদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

২০ দিন আগে বিয়ে করেছিলেন আনিস : শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, নিহত তিনজনের বাড়িতেই চলছে শোকের মাতম। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মো. আনিস বিয়ে করেছেন মাত্র ২০ দিন আগে। আনিসের মৃত্যুর খবরে তার ঘরে ছুটে এসেছেন স্বজনেরা। আহাজারি করতে করতে ঘরের ভেতর মূর্ছা গিয়ে পড়ে রয়েছেন তার স্ত্রী। বেশ কিছু নারী ও শিশু আর্তনাদ করে চলেছে। আনিসের বাবা আবু তাহেরকে দেখা যায় ঘরের এক কোণে বসে আছেন। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল তার। কান্নাজড়িত সুরে তিনি বলেন, ছেলে আমার নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে মাত্র ২০ দিন আগে। এর মধ্যেই তার বউটা বিধবা হলো। আমি মেয়েটাকে কী বলে সান্তনা দেব, আমার ছেলেটারেও তো আর পাব না।

আরাফাতের ঘরে গিয়ে দেখা যায়, আহাজারি করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তার নানি বিবি আমেনা। জ্ঞান ফিরতেই কেবল চিৎকার করে বলছেন, আমার সোনার চানরে কোথায় নিলা আল্লাহ। স্বজনেরা জানান, শৈশবেই আরাফাত মাকে হারান। মায়ের মৃত্যুর পর নানি বিবি আমেনা কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন আরাফাতকে।

জিয়াউর রহমানের একমাত্র ছেলে মো. রিয়াজ। ছেলে চাকরি করে কিছুটা আয় রোজগার করায় সচ্ছলভাবে চলছিল সংসার। তবে ট্রেন দুর্ঘটনা যেন সব এলোমেলো করে দিয়েছে। জিয়াউর রহমান আহাজারি করছিলেন, আমার শান্ত ছেলেটারে কেন নিয়ে গেলা আল্লাহ।

কী ঘটেছিল রাতে : বৃহস্পতিবার রাতে রাতে দুর্ঘটনায় তিন তরুণ নিহতের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন একই এলাকার বাসিন্দা মো. রায়হান হোসেন। দুর্ঘটনার সময় রেললাইন থেকে লাফ দিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন বলে জানান তিনি। রায়হান বলেন, রাত ৮টার দিকে তারা চারজন পূর্ব পাশের চট্টগ্রামমুখী রেলপথ ধরে উত্তর দিকে হেঁটে বিএসআরএম কারখানার দিকে যাচ্ছিলেন। ওদের হেডফোন আর মোবাইলের দিকেই মনোযোগ ছিল। মুঠোফোন দেখে কথা বলে বলে হাঁটছিলেন। সামনে ট্রেন এলে দেখব ভেবে রেললাইন ধরে হেঁটেছি। হাঁটার সময় বারবার ট্রেনের হুইসেল শুনলেও আমরা ভেবেছি পাশের লেন দিয়ে ট্রেন আসছে। এর মধ্যেই ট্রেন কাছাকাছি চলে আসে। ট্রেনের ধাক্কায় আরাফাত, আনিস ও রিয়াজ রেললাইন থেকে ছিটকে পড়ে।

দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী স্থানে ছিলেন মধ্যম সোনাপাহাড় এলাকার বাসিন্দা মো. শাহাদাত হোসেন। দুর্ঘটনার পর তিনি উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন। শাহাদাত হোসেন বলেন, সচরাচর দেখি, ঢাকাচট্টগ্রাম রেলপথের পশ্চিম লেনে ঢাকামুখী আর পূর্ব লেনে চট্টগ্রামমুখী ট্রেন যায়। তবে সোমবার দুপুর থেকে সোনাপাহাড় এলাকা অংশে সব ট্রেন চট্টগ্রামমুখী লেনে চলছিল। তিনি বলেন, পেছন থেকে ট্রেন আসার বিষয়টি বুঝতে না পেরে তিন তরুণের মৃত্যু হয়েছে।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, নিহত তিন তরুণ অমনোযোগী হয়ে রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন। তখন ঢাকামুখী সোনার বাংলা ট্রেন তাদের ধাক্কা দেয়। ট্রেনের ধাক্কায় তিনজন নিহতের ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার আবু জাফর বলেন, কয়েক দিন ধরে ভারী বৃষ্টিতে মীরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ঝরনা রাস্তার মুখে প্রচন্ড গতিতে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে ঢাকাচট্টগ্রাম রেললাইনের ওপর থাকা একটি কালভার্টের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকায় ওই মীরসরাইয়ের একটি অংশে এক লেন দিয়ে ট্রেন চলাচল করেছে। তিনি আরও বলেন, রেললাইনে এখন মানুষের অবৈধ অবস্থান যে হারে বাড়ছে, তা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এখন রেললাইনে বসে মানুষ আড্ডা দেওয়া থেকে শুরু করে মুঠোফোনে ব্যস্ত থাকছে এসব একেবারেই বেআইনি।

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাতে রেললাইনে নিহত যুবকরা যথাক্রমে দিদারুল আলমের ছেলে মো. আরাফাত (১৮), আবু তাহেরের ছেলে মো. আনিস (১৮) ও জিয়াউর রহমানের ছেলে মো. রিয়াজ (১৮)

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধইরানের সমর্থনে তেহরান-বাগদাদ বৈরুতের রাস্তায় লাখো মানুষ