ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ ঘটনা রোধে সচেতনতা বাড়াতে হবে

| শুক্রবার , ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

‘পাথর নিক্ষেপ’ রেল যাত্রীদের জন্য এক মহা আতঙ্ক। দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পাথরে প্রায় প্রতিনিয়ত আহত ও নিহত হচ্ছেন যাত্রীরা। এ ধরনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, পাথর নিক্ষেপে প্রতি বছর রেলওয়ের ক্ষতি হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। পাথরের আঘাতে দরজা-জানালার ভাঙা কাচসহ অন্যান্য সামগ্রী মেরামত করতে রেলওয়ের বছরে পৌনে দুই কোটি টাকা খরচ হয়। বছরে অন্তত দেড় শতাধিক পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ২০টি জেলায় পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ৫টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫টি জেলা রয়েছে। আর গুরুত্বপূর্ণ স্পট হিসাবে ৬৫টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলে ৩৬টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ২৯টি। রেলওয়ের হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে পাথর ছুঁড়ে ট্রেনের জানালা-দরজার কাচ ভাঙার ঘটনা ঘটেছে দুই হাজারের বেশি।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ থামছে না/ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নতুন কোচ ও ইঞ্জিন’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। ট্রেনে দুর্বৃত্তদের পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় ইন্দোনেশিয়া ও কোরিয়া থেকে আমদানিকৃত নতুন ইঞ্জিন ও কোচ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আহত হচ্ছেন যাত্রীরা। পাথর নিক্ষেপের ঘটনা রোধে রেলওয়ে পুলিশসহ রেল কর্মকর্তাদের নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচি চলছে। এর মাঝেও থেমে নেই পাথর নিক্ষেপ। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের বিরতিহীন সবচেয়ে আধুনিক ও উচ্চগতির ট্রেন সোনার বাংলায় আবারো পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, দুপুরের দিকে সোনার বাংলা ট্রেনটি ফেনীতে পৌঁছালে পাথর ছুঁড়তে শুরু করে দুর্বৃত্তরা। এতে ট্রেনটির কাচ ভেঙে মাথায় আঘাত পান নাজিম উদ্দিন নামে এক যাত্রী।
রেলওয়ে পুলিশ চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী আজাদীকে জানান, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ বন্ধে নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করে আসছি। তারপরও পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। যেখানে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে সেখানে সাথে সাথে অফিসার পাঠাচ্ছি। ঘটনা তদন্ত করছি। দোষীদের ধরার চেষ্টা করছি।
ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে মারার মতো এমন প্রাণঘাতী ও নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের পেছনে যে মনস্তত্ত্ব কাজ করে, তা নিয়ে পত্রিকান্তরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা এই কর্মকাণ্ডকে দেখছেন ‘মনোবিকৃতি’ হিসেবে। যার মাধ্যমে পাথর নিক্ষেপকারীরা মূলত এক ধরনের অসুস্থ আনন্দ পেতে চান। এ ব্যাপারে অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সাধারণত দুই-তিনটা ঘটনার কারণে এটা হয়ে থাকে। প্রথমত যে পাথর নিক্ষেপ করছে, সে মনে করতে পারে যে, সে কোনো সামাজিক বা সোশ্যাল ইনজাস্টিসের মধ্যে আছে। অর্থাৎ তার প্রতি একটা অবিচার হচ্ছে। ট্রেন একটা জায়গা দিয়ে যাচ্ছে। সেটা তার সহ্য হচ্ছে না। তার ভালো লাগছে না। কারণ কোনো না কোনো জায়গা থেকে সে হতাশাগ্রস্ত। হয়তো তার (পাথর নিক্ষেপকারী) পারিবারিক জীবনে কোনো হতাশা আছে। পেশাগত জীবনে কোনো হতাশা আছে। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সে পাথরটা ছোঁড়ে। ট্রেন একটা সহজ লক্ষ্যবস্তু, নিরাপদ লক্ষ্যবস্তু। কারণ ট্রেন পাল্টা পাথর ছোঁড়ে না। সুতরাং সে সহজ জিনিসকে আঘাত করে। এর ভেতর দিয়ে সে হতাশাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ‘অবজারভেশনাল লার্নিং’ বা অন্যকে দেখে শেখার মতো একটা বিষয়কে হাজির করেন এই মনস্তত্ত্ববিদ। বলেন, ‘এটাকে মাস সাইকোলজিও বলা যায়। গণমনস্তাত্ত্বিক সাইকোলজি। গণপিটুনির ক্ষেত্রে যেটা ঘটে। যে লোকটিকে মারা হচ্ছে, তাকে হয়তো কেউ চেনেই না। কী কারণে মারছে সেটাও জানে না। দেখা যায়, একজন মার শুরু করলে পাঁচ-সাত জন তাকে মারা শুরু করলো।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, যে সব পয়েন্টে এগুলো ঘটছে সেসব এলাকার লোকজনের বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা, সেটা জানাটা জরুরি। যেমন হরতাল হলে গাড়ি দেখলে তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এটা একটা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হলেও তার পেছনে একটা উদ্দেশ্য থাকে। ফলে তারা সেটাকে অপরাধ মনে করে না। তাই যারা পাথর ছুঁড়ে মারছে তারাও এমন কিছু মনে করছে কিনা সেটা পরিষ্কার নয়। তিনি আরও বলেন, ‘আবার যারা পাথর ছুঁড়ছে, নিছক আনন্দের জন্যও তারা এটা করে থাকতে পারে। তারা ধরেই নেয় যে, এতে কেউ আহত হবে। এর ভেতর দিয়ে তারা একটা অসুস্থ আনন্দ পাচ্ছে। যেটা এক ধরনের মনোবিকৃতি।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রোধে সমাজের পাশাপাশি পরিবারেরও সচেতনতা বাড়াতে হবে। পাথর নিক্ষেপে ভুক্তভোগী ব্যক্তির পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও বহুবিধ ক্ষতি সাধন হয়। তাই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা রোধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধজাম্বিয়ার জাতীয় দিবস