মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া শুল্ককে অবৈধ অ্যাখ্যা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাণিজ্য আদালত। গত বুধবারের রায়ে তারা বলেছে, হরে–দরে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি পণ্যে শুল্ক দিয়ে প্রেসিডেন্ট সাংবিধানিকভাবে তাকে দেওয়া এখতিয়ারের সীমা অতিক্রম করেছেন। মার্কিন পণ্য যে পরিমাণ কেনে, দেশটিতে তার চেয়ে বেশি অর্থের পণ্য বিক্রি করে এমন প্রায় সব দেশের ওপর গত ২ এপ্রিল অতিরিক্ত সম্পূরক শুল্ক বসিয়েছিলেন ট্রাম্প। দিনটিকে আমেরিকার ‘অর্থনৈতিক মুক্তির দিন’ হিসেবেও অভিহিত করেছিলেন তিনি।
বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক আদালত বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান কংগ্রেসকে বাণিজ্য সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। দেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত করতে প্রেসিডেন্ট যে জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন, তা কংগ্রেসের ওই বিশেষ ক্ষমতার এখতিয়ারকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। আদালতের এই রায় ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য জোর ধাক্কা হয়ে এসেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। খবর বিডিনিউজের।
চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে প্রেসিডেন্টের শুল্ক আরোপ কার্যকর কিনা, বা তিনি ঠিক করেছেন না ভুল সে বিষয়ে আদালত কোনো মন্তব্য করছে না। কিন্তু (প্রেসিডেন্টের এই ক্ষমতা) ব্যবহারের সুযোগ নেই, এটা ঠিক নয় বা অকার্যকর–সে কারণে নয়, ফেডারেল আইন এই ক্ষমতা ব্যবহারের অনুমতি দেয় না, রায়ে এমনটাই বলেছে তিন বিচারকের এক প্যানেল। রায়ের পরপরই ট্রাম্প প্রশাসন এর বিরুদ্ধে আপিলের নোটিস দিয়েছে, তারা প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তে আদালতের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
ম্যানহাটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক আদালতে মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শুল্ক সংক্রান্ত বিবাদের শুনানি হয়। তাদের রায়ের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন ডিসির ইউএস কোর্ট অব আপিলস ফর দ্য ফেডারেল সার্কিট এবং শেষ পর্যন্ত মার্কিন সুপ্রিম কোর্টেও যাওয়া যায়। অন্য দেশ থেকে আমদানি পণ্যে শুল্ক আরোপকে ট্রাম্প তার চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের মূল হাতিয়ার বানিয়েছেন। তার এ পদক্ষেপের ফলে বিশ্ব বাণিজ্য ও শেয়ার বাজারগুলোতে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। ছোট–বড় সব প্রতিষ্ঠানকেই ট্রাম্পের দ্রুত শুল্ক আরোপ এবং হুটহাট সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে ভুগতে হচ্ছে; সরবরাহ শৃঙ্খলা, উৎপাদন, কর্মী নিয়োগ ও মূল্য নির্ধারণে পড়তে হচ্ছে তুমুল অসুবিধায়।
বুধবার হোয়াইট হাউজের এক মুখপাত্র বলেছেন, অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ‘একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা, যা আমেরিকান সমপ্রদায়গুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, আমাদের শ্রমিকদের পিছিয়ে দিয়েছে, এবং আমাদের প্রতিরক্ষা শিল্পের ভিত্তিকে দুর্বল করেছে’ এগুলো এমন সব সত্য যা নিয়ে আদালতও আপত্তি জানাতে পারে না। কীভাবে একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করা যায়, সেই সিদ্ধান্ত অনির্বাচিত বিচারকদের নয়, বিবৃতিতে এমনটাই বলেছেন মুখপাত্র কুশ দেশাই। তবে মার্কিন বাণিজ্য আদালতের সিদ্ধান্তের পর বিশ্বজুড়ে শেয়ার বাজারে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মার্কিন ডলারের মানও ইউরো, ইয়েন ও সুইস ফ্রাঁ–র তুলনায় বেড়েছে।
এই রায় বহাল থাকলে তা শুল্ককে চাপ হিসেবে ব্যবহার করে বাণিজ্য অংশীদারদের কাছ থেকে নানান ছাড় নেওয়ার ট্রাম্পের কৌশল ব্যর্থ করে দেবে। যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ফেরানো, চাকরি বাড়ানো এবং ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা– এগুলোই নির্বাচনী প্রচারণায় তার দেওয়া অঙ্গীকারগুলোর কেন্দ্রে ছিল। বাণিজ্য আদালতের এই রায় আপিলেও টিকে গেলে ট্রাম্প আর হুটহাট শুল্ক বাড়াতে–কমাতে পারবেন না। ‘জাতীয় জরুরি অবস্থার’ মধ্যে ‘অস্বাভাবিক ও মারাত্মক হুমকি’ মোকাবেলার লক্ষ্যে থাকা ইন্টারন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ইকোনমিক পাওয়ার অ্যাক্ট (আইইইপিএ) ব্যবহার করে যেমনটা তিনি করেছিলেন। এর বদলে তার প্রশাসনকে অন্য বাণিজ্য আইনের অধীনে সময়সাপেক্ষ তদন্ত করে ধীরে ধীরে ব্যবস্থা নিতে হবে।
দুটি মামলার প্রেক্ষিতে বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালত ট্রাম্পের শুল্ককে অবৈধ অ্যাখ্যা করেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। তার মধ্যে একটি করেছে বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি করা ৫ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লিবার্টি জাস্টিস সেন্টার, অন্যটি ১৩ মার্কিন রাজ্য।
দল নিরপেক্ষ লিবার্টি জাস্টিস সেন্টার যাদের হয়ে মামলা করেছে তাদের মধ্যে নিউ ইয়র্কের এক মদ আমদানিকারক থেকে শুরু করে ভার্জিনিয়াভিত্তিক শিক্ষা উপকরণ ও মিউজিকাল সরঞ্জাম নির্মাতাও রয়েছে। এ কোম্পানিগুলো বলছে, ট্রাম্পের শুল্ক তাদের ব্যবসা করার সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এটা কেবল বাদীদের ক্ষেত্রে আলাদা সুবিধা দেওয়ার বিষয় নয়। যদি শুল্ক আদেশগুলো তাদের জন্য অবৈধ হয়, তাহলে তা সবার জন্যই অবৈধ, রায়ে এমনটাই লিখেছে বাণিজ্য আদালত।
ট্রাম্পের শুল্কের বিরুদ্ধে আরও অন্তত ৫টি মামলা এখনও বিচারাধীন। রাজ্যগুলোর মামলার নেতৃত্বে ছিলেন অরেগনের অ্যাটর্নি জেনারেল ড্যান রেফিল্ড। তিনি প্রেসিডেন্টের শুল্ককে ‘অবৈধ, বেপরোয়া ও অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসাত্মক’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন। এই রায়ে আবারও প্রমাণ হয়েছে যে আমাদের আইন গুরুত্বপূর্ণ এবং বাণিজ্যসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্টের খেয়ালখুশিমতো হয় না, বলেছেন তিনি। মার্কিন আইন মন্ত্রণালয় এ মামলাটি খারিজ করে দিতে বিচারকদের অনুরোধ জানিয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল, বাদীপক্ষ এখনো শুল্ক পরিশোধ করেনি–ফলে তারা কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, এমনটা বলা যায় না।
ট্রাম্পের দাবি, তিনি আইইইপিএ–র অধীনে শুল্ক নির্ধারণের বিস্তৃত ক্ষমতা রাখেন। অতীতে এ আইনটি ব্যবহৃত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বৈরি দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ বা তাদের সম্পদ জব্দে। এবারই প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুল্ক বসাতে আইনটিকে কাজে লাগালেন।