রাতের খাবার একসাথে খেয়েছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বোন নেই। বিকাল পর্যন্ত আশেপাশেই ছিল। এরপর তাকে আর দেখেনি লোকজন। পরদিন ভোর রাতে (২৯ জুন) ট্রাক চাপায় নিহত হয় আমার বোন মিনু। ৫ দিন আগের ঘটনা হলেও বিষয়টি আমি গত শনিবার পুলিশ মারফত জানতে পারি।
কথাগুলো বলছিলেন মিনুর ভাই রুবেল। বোন মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল উল্লেখ করে তিনি আজাদীকে বলেন, অন্যের হয়ে তিন বছর জেল খেটে গত ১৬ জুন মুক্তি পায় বোন। এরপর ১ ছেলেসহ আমার বাসায় ছিল। বাসা থেকে বের হতে দিতাম না। মিনু ও রুবেলের বাড়ি কুমিল্লার ময়নামতিতে। বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড এলাকার ছিন্নমূল বস্তিতে ১৮ বছর ধরে বসবাস করছেন। ছোট থাকতেই মারা যান বাবা সোলায়মান। কয়েক বছর আগে মারা যান মা সালেহা বেগম। এরপর মিনু ও রুবেলের অন্যরকম পথচলা শুরু।
কারাগারে থাকতেই তিন সন্তানের একজন জান্নাতকে হারান মিনু। বাকি দুই সন্তানের একজন ইয়াসিন। নগরীর দুই নম্বর গেটের একটি চায়ের দোকানে কাজ করে। অপর ছেলে গোলাপ হোসেন সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর এলাকার হুসাইনিয়া হাসানিয়া দাখিল মাদ্রাসার হেফজ বিভাগে পড়াশোনা করছেন।
রুবেল জানান, সে বিয়ে করেছে। তার ১ বছরের একটি কন্যা শিশু রয়েছে। সন্তান, বউ, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে সে আলাদা থাকে। বোন থাকত অন্য জায়গায়। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মিনু তার সাথেই ছিল।
তিনি বলেন, কারাগারে থাকতেই মিনুর স্বামী মিনুকে ছেড়ে চলে যায়। এখন সেও পরপারে চলে গেল। দুই সন্তানের আমি ছাড়া আর কেউ রইল না। তিনি বলেন, মিনু কিভাবে মারা গেছে আমি জানি না। পুলিশ বলছে, ট্রাক চাপায় মারা গেছে।
এদিকে মিনুর আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ আজাদীকে বলেন, কারাগার থেকে বের হওয়ার ১২ দিনের মাথায় মিনু ট্রাক চাপায় মারা গেছে-বিষয়টি মানতে পারছি না। তিনি যেখানে থাকতেন দুর্ঘটনাস্থল সেখান থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে। তিনি এত দূরে কীভাবে এলেন? তিনি তো মানসিকভাবে অসুস্থ। বিষয়টি রহস্যজনক। অন্য কোনোভাবে তার মৃত্যু হয়েছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। প্রয়োজনে লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করা হোক। এর পেছনের অন্য কেউ জড়িত আছে কিনা খুঁজে বের করা হোক।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামান আজাদীকে বলেন, ২৮ জুন রাতে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের সানমার গ্রিনপার্কের সামনের সড়কে দ্রুতগতির ট্রাক চাপায় মিনুর মত্যৃু হয়। সে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কয়েকবার রাস্তা থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে আমরা তার পরিচয় তখনো শনাক্ত করতে পারিনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। পরে গত শনিবার আমরা তাকে মিনু হিসেবে শনাক্ত করি। মিনুর ভাই রুবেল আমাদের সহযোগিতা করেন। ওসি বলেন, এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। আমরা তদন্ত করে দেখছি। অন্য কোনো কারণ থাকলে তা তদন্তে বের হয়ে আসবে।
তিন বছর সাজা ভোগ করার পর গত ১৬ জুন কারাগার থেকে বের হয়ে মিনু গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আমি কাউকে কিছু করি নাই। চাল-ডাল, ভালো জামা দেবে বলে কারাগারে ঢোকাই দিছে। আমি এখন ভালোমতো বাঁচতে চাই। ছিন্নমূলে থাকার সময় প্রতিবেশী মর্জিনার সাথে আমার পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে সে কুলসুম নামের একজনের হয়ে আমার কাছে এসে বলে, এক জায়গায় গেলে তোকে চাল-ডালসহ টাকা দেওয়া হবে। তোর নাম হবে কুলসুম। কুলসুম বলে কেউ ডাকলে তুই হাত তুলবি। ১ মাসের বেশি তোকে সেখানে থাকতে হবে না। সেদিন মিনু আরও বলেন, আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া তিনটি বছর ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
গত ৩১ মার্চ মিনুর অন্যের হয়ে সাজা ভোগ করার ঘটনাটি জনস্বার্থে উচ্চ আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে কোতোয়ালী থানাধীন রহমতগঞ্জের একটি বাসায় মোবাইল ফোনে কথা বলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গার্মেন্টসকর্মী কোহিনূর আক্তারকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। এরপর তার লাশ রহমতগঞ্জের একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় প্রথমে একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের হলেও পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপ নেয়। পরে কুলসুম আক্তারকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। আদালত সেই চার্জশিট আমলে নিয়ে কুলসুমের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রয়োজনীয় সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক কার্যক্রম শেষ করে তৎকালীন অতিরিক্ত ৪র্থ মহানগর দায়রা জজ আদালত কুলসুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ১ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোনা জারি করেন।
আদালত সূত্র জানায়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও গ্রেপ্তারি পরোনা জারির পর কুলসুম কৌশলে তার জায়গায় মর্জিনা নামের একজনের মাধ্যমে মিনুকে আদালতে উপস্থাপন করেন এবং তার নির্দেশ মতে মিনু আদালতে নিজেকে কুলসুম দাবি করেন। ২০১৮ সালের ১২ জুন কুলসুমের জায়গায় মিনুকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। মিনুর করুণ পরিণতির জন্য দায়ী কুলকুম লোহাগাড়া উপজেলার আহাম্মদ মিয়ার বাড়ির আনু মিয়ার মেয়ে।