ট্যানারি শিল্প বিকাশে বাধা কোথায়

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ২৫ জুন, ২০২৪ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, এবারের কোরবানিতে প্রায় ০১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮ টি পশু জবেহ করা হয়েছে। সে আলোকে প্রতি কোরবানি ঈদে এক কোটি চামড়ার যোগান হয়। এছাড়াও প্রতিদিনও বিভিন্ন উপলক্ষ্যে পশু জবেহ হয় নিয়মিত।

বাংলাদেশের চামড়ার গুণগত মান অনেক ভালো, শ্রমও তুলনামূলক কম। কোনো ধরনের কাঁচামাল আমদানির উপর নির্ভরশীলতা ছাড়াই চামড়া বা ট্যানারি শিল্পের বিকাশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের দেশে। এরপরও বিপুল সম্ভাবনাময় এ ট্যানারি শিল্পের বিকাশ কেন হচ্ছে না?

স্বাধীনতা পরবর্তীতে চট্টগ্রামের চাক্তাই সংলগ্ন চামড়ার গুদাম আমরা দেখেছি। সেখানে ট্যানারি শিল্পের জন্য চামড়া সংরক্ষণ করা হতো। কালুরঘাট নেক্সাস শিল্প এলাকা এবং অক্সিজেনের বালুচড়ায় অনেক ট্যানারি শিল্পের ভালো অবস্থা ছিল। সে সময় ৬০/৬৫ হাজার দামের গরুর চামড়া ৪/৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে চড়া মূল্যে চামড়া বিক্রি হয়। এরপর চামড়ায় বড় ধরণের ধস নামে। কালের বিবর্তনে আস্তে আস্তে তা বন্ধ হয়ে গেছে, ঢাকার হাজারিবাগ হতে ট্যানারি শিল্প সাভারের হরিণধরায় স্থানান্তর করা হয়। ২০০ একর জমির উপর এ শিল্প নগরী গড়ে উঠেছে। ২০০৩ সালে নেওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ ১২ দফা বাড়ানোর পাশাপাশি ১৭৫ কোটি টাকার পরিবর্তে ১০১৫ কোটি খরচ করা হলেও পরিবেশ দূষণ বন্ধে কমনক্রোন রিকভারি ইউনিট নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। এছাড়া সলিড ওয়েষ্ট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে রিসোর্স জেনারেশন ব্যবস্থাও রাখা হয়নি।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু চামড়া শিল্পের কাঁচামাল চামড়া দেশেই উৎপাদিত হয়। আমদানি নির্ভর পোশাক খাত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ আজ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানে পৌঁছেছে। রাষ্ট্রীয় অবহেলা, অদূরদর্শিতা এবং সময়পোযোগী পরিকল্পনার অভাবে দেশে উন্নতমানের কাঁচা চামড়ার বিপুল সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও ট্যানারি শিল্প সে অনুযায়ী বিকশিত হতে পারেনি।

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্প দেশের অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ খাতে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৬ লাখ এবং পরোক্ষভাবে আরও ৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থান জড়িত। দেশের মোট রপ্তানি মধ্যে এখাতের অবদান ৪% যা দেশের মোট জিডিপির ০.%। সরকার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যকে ২০১৭ সালে ‘প্রোডাক্ট অব দি ইয়ার/বর্ষপণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০২৪ সালে এ খাত থেকে মোট রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মোট জিডিপির ১% বৃদ্ধি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

সম্ভাবনাময় এ শিল্পটিকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। বিগত সময়ে কোরবানির পশুর চামড়া গর্ত করে পুতে নষ্ট করা হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে লক্ষ লক্ষ চামড়া। গরুর চামড়া বিক্রির টাকা গরীবদের অংশ ২০১৩ এরপর গরীবরা এ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। ২০২২২৩ অর্থবছরে দেশে পর্যাপ্ত কাঁচামাল থাকার পরও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি মাত্র ১২২ কোটি ডলার। এ সময় চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল প্রায় ৪৬৮ বিলিয়ন বা ৪৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ চামড়ার বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের অংশ মাত্র ২৬ শতাংশ।

বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও দেশীয় চামড়াশিল্পের বিকাশ না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো দেশের চামড়াশিল্পের কমপ্লায়েন্স (দূষণমুক্ত ও উন্নত কর্মপরিবেশ) অর্জন করতে না পারা। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) এক গবেষণা অনুসারে, যেসব কারণ দায়ী, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) সক্ষমতার অভাব, কমপ্লায়েন্স সম্পর্কে ট্যানারি মালিকদের যথাযথ ধারণা না থাকা, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও ট্যানারির অভ্যন্তরীণ পরিবেশের মান উন্নত না হওয়া।

এসব কারণে চামড়াশিল্পের মানসনদ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) থেকে স্বীকৃতি পাচ্ছে না সাভারে অবস্থিত ট্যানারিগুলো। ফলে দেশে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ইউরোপের বদলে চীনের বাজারে কম দামে রপ্তানি করতে হচ্ছে।

দেশের চামড়াশিল্প কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে এত পিছিয়ে আছে যে, বাংলাদেশে এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ট্যানারির সংখ্যা মাত্র ৬টি, অথচ এ সংখ্যা ভারতে ১৩৯, চীনে ১০৩, ইতালিতে ৬৮, ব্রাজিলে ৬০, তাইওয়ানে ২৪, স্পেনে ১৭, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কে ১৬ ও ভিয়েতনামে রয়েছে ১৪টি। এলডব্লিউজি সনদ না থাকার কারণে চামড়ার বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। দেশীয় কাঁচা চামড়ার পর্যাপ্ত জোগান থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পকারখানাগুলোকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ফিনিশড চামড়া আমদানি করতে হয়, যা কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা খাত খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিশ্বে সকল ধরণের তৈরি পাদুকার উৎপাদন ২০১০ সালের ১৭.৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬ সালে ২১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। ২০১৭ সালে এখাতে সেই বৈশ্বিক বাজারের আকার ছিল ১৩৯.৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাদুকা উৎপাদনে ২০১৬ সালে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল অষ্টম। বাংলাদেশের ২২০টি ট্যানারি থেকে উৎপাদিত প্রক্রিয়াজাত চামড়ার মধ্যে ৭৬% এর বেশি রপ্তানি করা হয়। এ অবস্থায় উন্নয়নের আরো সুযোগ রয়েছে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশকে ক্রমান্বয়ে আরও বৃহত্তর পরিসরে অঙ্গীভূত হওয়া প্রয়োজন।

বছরে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বর্গফুট কাঁচা চামড়া (হাইড ও স্কিন) প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এর মধ্যে গরুর চামড়া হলো ৬৩.৯৮%, ছাগলের চামড়া ৩২.৭৪%, মহিষের চামড়া ২.২৩% এবং ভেড়ার চামড়া ১.০৫% (২০১৭ সালের হিসাবনুযায়ী)

২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে সরিয়ে নেওয়া হলেও এ শিল্প দূষণমক্ত হয়নি। কারণ বিপুল অর্থ ব্যয় করে দুই বছরের বদলে নয় বছর সময় নিয়ে নির্মিত সিইটিপি চামড়া শিল্পের সব ধরনের বজ্য পুর্ণমাত্রায় পরিশোধনে সক্ষম নয়।

সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে দৈনিক ২০০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থপনায় জন্য স্লাজপাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম (এসপিজিএস) না থাকায় উৎপাদিত কঠিন বর্জ্য অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদভাবে ৬ একর আয়তনের একটি ডাম্পিং জোনে গর্ত করে জমা করা হয়। ফলে বুড়িগঙ্গার বদলে সাভারের ধলেশ্বরী নদী দূষিত হচ্ছে এবং চামড়া শিল্প পরিবেশবান্ধব পাচ্ছে না। চামড়া খাতের প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্রান্ড ওরিয়েইনারদের আস্থা অর্জনে প্রক্রিয়াজাত চামড়ার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পুরনের জন্য বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্পকে তার সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা এখন জরুরি। বিশ্ববাজারের প্রধান প্রধান ব্র্যান্ড ওরিয়েইনারদের পণ্য সম্পর্কে এদেশের উদ্যোক্তাদের যথাযথ ধারনা থাকা প্রয়োজন। স্থানীয় প্রস্তুতকারীদের উৎপাদনশীলতা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে উপনীত হওয়া উচিত। সময়োপযোগী ফ্যাশনে পণ্য এবং বাজারের ভবিষ্যৎ চাহিদা পর্যাবেক্ষণের ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি চামড়া শিল্পের সকল পর্যায়ে পরিবেশ সুরক্ষা এবং পরিচ্ছন্ন উৎপাদনে জড়িত সকলকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। এজন্য যুগোপযোগী ব্যবসায়িক মডেল গ্রহণ করতে হবে। চামড়া শিল্প কারখানাসমূহে ব্যবসা এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এ জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

আজকে আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে, পরিবেশ দূষণ ও অনুন্নত কর্মপরিবেশের কারণে দেশীয় চামড়া শিল্প এমন একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে একদিকে চামড়া ব্যবসায়ীরা উপযুক্ত মূল্য না পেয়ে বঞ্চিত হচ্ছে এবং এতিমখানা, মাদ্রাসা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও।

দেশে বড় বড় ইকনোমিক জোন স্থাপন করা হচ্ছে। কিন্তু জোন সমূহে যে সব সুবিধাদি থাকা প্রয়োজন সে সব বিষয়ে নিশ্চিত ব্যবস্থা না করে অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়ে চলমান শিল্প সমূহ বন্ধ করে দিয়ে উৎপাদনশীলতা নষ্ট করা হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। দেশীয় শিল্পে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অপরিণামদর্শী পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সমূহে সমন্বয়হীনতা দেশের অর্থনীতিতে ও শিল্প বিকাশের গতি রুদ্ধ হচ্ছে।

সরকারের উর্ধ্বতন মহলকে বিষয়গুলো নিয়ে বাস্তব ভিত্তিক পরিকল্পনা নিয়ে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই উন্নয়নশীল সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে মান রক্ষা করে ট্যানারি শিল্পের বিকাশ সম্ভব।

তথ্যসূত্র : . বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিভা) প্রতিবেদনসেপ্টেম্বর২০২৩। ২. বিসিকের গবেষণা প্রতিবেদন জুন২০২৩। ৩. কল্লোল মোস্তাফার প্রতিবেদন, চামড়া শিল্প। ৪. চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উন্নয়ন নীতিমালা ২০১৯ শিল্প মন্ত্রণালয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপান : চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত
পরবর্তী নিবন্ধ‘চিরন্তন চট্টগ্রাম’ হোক সামগ্রিক চট্টগ্রামের আয়না