ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্যে পোল্ট্রি ও মাছের খাবার

অনুমোদিত খাবারের চড়া মূল্য ।। খামারে মুরগী বড় হচ্ছে আমদানি নিষিদ্ধ মিট অ্যান্ড বোন মিল

হাসান আকবর | রবিবার , ৮ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

আমদানি নিষিদ্ধ ‘মিট অ্যান্ড বোন মিল’ এবং ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে কোটি কোটি টাকার পোল্ট্রি ফিড এবং মাছের খাদ্য তৈরি করা হচ্ছে। চট্টগ্রামে গড়ে উঠা সংঘবদ্ধ একটি চক্র মানুষ ও পশুপাখিদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসব পোল্ট্রি ফিড এবং মাছের খাদ্য বাজারজাত করছে। চট্টগ্রামসহ সন্নিহিত এলাকার অন্তত ৩০ হাজার পোল্ট্রি ফার্মসহ বিপুল সংখ্যক মাছের খামারকে টার্গেট করে ঝুঁকিপূর্ণ এসব পোল্ট্রি ফিড উৎপাদন এবং বাজারজাত করা হচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে অধিকাংশ খামারই মুরগীর মাংস উৎপাদন করে। একদিন বয়সী বাচ্চাকে এক মাসেরও বেশি সময় লালনপালন করে বিক্রি করা হয়। একটি একদিনের বাচ্চাকে এক থেকে দেড় কেজি ওজন করতে দুই থেকে তিন কেজি খাবার খাওয়ানো হয়। প্রচুর দাম খাবারের। ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা খাবারের গতকালের বাজার দর ছিল তিন হাজার ৩শ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি খাবারের দাম ৬৬ টাকা। মুরগীর খাবারই খামার শিল্পে অন্যতম একটি বড় খরচ হিসেবে বিবেচিত হয়। অপরদিকে চট্টগ্রামের বিস্তৃত এলাকায় শত শত মৎস্য খামার রয়েছে। যেখানে কোটি কোটি টাকার মাছের খাবার বিক্রি হয়ে থাকে।

অভিযোগ রয়েছে, খামারের অতি দামি এই খাবারকে টার্গেট করে সংঘবদ্ধ একটি চক্র কোটি কোটি টাকার বেসাতি করছে। মুরগী এবং মাছের খাদ্য হিসেবে জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর পণ্য খাওয়ানো হচ্ছে মাছ এবং মুরগীর বাচ্চাকে। খাবারের চড়া মূল্যের সুযোগে নানা ধরনের ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। বাড়ছে ভেজাল দিয়ে মাছ ও মুরগীর খাবার উৎপাদনের প্রবণতা। বিভিন্ন খামারে লালিত পালিত মুরগী বড় হচ্ছে আমদানি নিষিদ্ধ ‘মিট অ্যান্ড বোন মিল’ এবং ট্যানারির বর্জ্য মেশানো খাবার খেয়ে। একমাসের মধ্যে মুরগীগুলো মানুষের পাতে উঠছে। একইভাবে মাছের খাবারেও মেশানো হচ্ছে এসব পণ্য। যার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব বহন করতে হচ্ছে মানব শরীরে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মিট অ্যান্ড বোন মিল সংক্ষেপে ‘এমবিএম’ নামে পরিচিত। এই প্রোটিন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টির পাশাপাশি অ্যানথ্রাঙ ও ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য রোগের অন্যতম কারণ। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতায় মানুষ এক ভয়াবহ বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখে পড়ে। ক্যান্সারের ভয়াল অবস্থার জন্য ভেজাল পোল্ট্রি ফিড অনেকাংশে দায়ী বলেও বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পাউডারের মতো দেখতে এই প্রোটিন গরু, ছাগল, শুকর, ভেড়াসহ বিভিন্ন প্রাণীর হাড় থেকে তৈরি করা হয়। হাড়ের সঙ্গে লেগে থাকা মাংসও সেই প্রোটিনে ব্যবহার করা হয়। একসময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পোল্ট্রি ফিড হিসেবে এই প্রোটিন ব্যবহার হলেও পরবর্তীতে ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তা নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ইউরোপের দেশগুলোতে নিষিদ্ধ হয় ‘মিট অ্যান্ড বোন মিল’। ভারতে নিষিদ্ধ করা হয় ২০০১ সালে। থাইল্যান্ড ২০১৭ সালে নিষিদ্ধ করে। বাংলাদেশে এই পণ্য নিষিদ্ধ করা হয় ২০১৯ সালে। কিন্তু নানা গোঁজামিল দিয়ে এই নিষিদ্ধ পণ্য আমদানি এবং ইতোপূর্বে আমদানিকৃত বেশ কিছু পণ্য নানা পন্থায় বাজারে এনে ব্যবহার করা হচ্ছে।

চট্টগ্রামে বড় ধরনের এক অভিযানে বিপুল পরিমাণ মুরগীর খাবার জব্দ করার পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বাকলিয়া থানার পুলিশ নগরীর রাজাখালী ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন ফাইভ স্টার গলির জনৈক হাজী সালাউদ্দিনের মালিকানাধীন তিনটি কারখানা ও গুদামে অভিযান চালায়। এসময় পোল্ট্রি খাদ্যের সাথে ট্যানারি বর্জ্য ও নিষিদ্ধ প্রোটিন মিশিয়ে পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদনের সত্যতা পেয়ে কারখানা ও গুদামগুলো তালাবদ্ধ করে দেয়া হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত কারখানার মালিক হাজী সালাউদ্দিনকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেন। এসময় ট্যানারি বর্জ্য মিশ্রিত এক ট্রাক পোল্ট্রি ফিড কর্ণফুলী নদীর তীরে নিয়ে ধ্বংস করে বলে বাকলিয়া থানা পুলিশ জানিয়েছে। জরিমানা এবং অঙ্গীকারপত্র নেয়ার পর কারখানা এবং গুদামের তালা খুলে দেয়া হয়েছে।

সালাহউদ্দীনের কারখানায় এবং গুদামে পাওয়া ক্ষতিকর পণ্যগুলো নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর কিংবা মৎস প্রাণী সম্পদ বিভাগ কিংবা ভোক্তা অধিকারের মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করালে অনেক বড় একটি বিষয় উদঘাটিত হতো বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, পণ্যগুলো ভেজাল হিসেবে ধরে ধ্বংস করার কথা বলা হলেও এসব পণ্য কারখানায় কোত্থেকে বা কিভাবে আনা হলো, এর সাথে কারা জড়িত, কি কি ধরনের ক্ষতিকর পণ্য ব্যবহৃত হয়েছে সেই তথ্যগুলো অজানা রয়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংঘবদ্ধ একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ এবং ক্ষতিকর পণ্য ব্যবহার করে পোল্ট্রি এবং মাছের খাবার তৈরি করে আসছে। চাক্তাই, রাজাখালী, বাস্তুহারাসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে এদের আস্তানা। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থাকে ম্যানেজ করে চক্রটি কোটি কোটি টাকার ভেজাল পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাত করছে।

সাম্প্রতিক অভিযানে রাজাখালী ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন ফাইভ স্টার গলির হাজী সালাউদ্দিনের ব্যাপারে অনুসন্ধান করে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বছর কয়েক আগে লেবার সর্দার (মাঝি হিসেবে প্রচলিত) সালাউদ্দিন ভেজাল পোল্ট্রি ফিডের ব্যবসা করে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন। তাদের সাথে আরো অনেকেই এই ব্যবসা করে। বর্তমানে সালাউদ্দিনের ছেলে সোহাগ ও ভাতিজা সাদ্দাম পোল্ট্রি ফিড ব্যবসা পরিচালনা করছে। অপর একটি সূত্র বলেছে, লোকচক্ষুর অন্তরালে এসব কারখানায় নানা গোঁজামিল দিয়ে খাদ্য উৎপাদনের নামে জনস্বাস্থ্যকে নিলামে তোলা হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্তের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভেজাল খাদ্য ধ্বংস করেছি। কারখানায় ভালো জিনিসের সাথে খারাপ জিনিস মিশিয়ে পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন করা হচ্ছিল। আমরা তাদের খারাপ জিনিসগুলো ধ্বংস করে দিয়েছি। আর যাতে এসব কাজ না করে সতর্ক করে দিয়েছি। দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তারা কারখানায় ভালো পোল্ট্রি ফিড উৎপাদন করলে কারো তো আপত্তি নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আরো দুজনের মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধইউপি সদস্যের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা