ট্যাক্স কমাতে ঘুষের প্রস্তাব

প্রতীকী গণ শুনানিতে অভিযোগ ১৫ হাজার টাকার কর এখন ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২২ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. মোজাম্মেল হোসাইন। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকায় তার চার তলা ভবনের গৃহকর ধার্য করা হয় তিন লাখ ১৪ হাজার টাকা, যা পূর্বে ছিল ৭০ হাজার টাকা। বর্ধিত গৃহকর কমানোর জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ট্যাক্স কালেক্টর ও তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে দুটি অপশন দেন। একটি আপিল করা এবং দ্বিতীয়টি ‘ঘুষ’ এর মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট করা।

এ বিষয়ে মোজাম্মেল বলেন, গত ৭ জুন ৪র্থ কোয়ার্টারের ট্যাক্স পরিশোধ করতে গেলে ট্যাক্স কালেক্টর ও তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে দুটি অপশন দেন। প্রথমত আপিল করতে বলেন। আপিল ফরমের জন্য দাবি করে তিন হাজার টাকা। দ্বিতীয়ত আপিল না করে কন্ট্রাক্টে (চুক্তি) গেলে গৃহকর এক লাখ টাকার মধ্যে করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। তবে সেজন্য ৮০ হাজার টাকা দাবি করেন। চসিকের ৭ নম্বর সার্কেলের সুজন নামে কর্মকর্তা এ ‘ঘুষ’র টাকা দাবি করেছেন বলে জানান তিনি। গতকাল অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ আয়োজিত প্রতীকী গণশুনানিতে এ অভিযোগ করেন তিনি। মোজাম্মেল বলেন, ১৯৯৪ সালে হোল্ডিং ট্যাক্স ছিল শুধুমাত্র এক হাজার টাকা। ২০০৮ সালে তা পাঁচ হাজার টাকা এবং ২০১২ সালে কোনো ধরনের এসেসমেন্ট না করেই নির্ধারণ করে এক লাখ ৪৪ হাজার টাকা। ওই সময় ট্যাক্স কালেক্টরকে বাধ্য হয়ে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিই। এতে ট্যাক্স ধার্য্য হয় ৭০ হাজার। সিটি মেয়রের কাছে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, আপনি বারবার বলেছেন ট্যাক্স না বাড়িয়ে পরিধি বাড়াচ্ছেন। তাহলে ৯১ সালে আমার বাড়ি ছিল চার তলা। ২০২২ সালেও চারতলাই আছে। কোনো পরিধি বাড়াইনি। এরপরও আমার ট্যাক্স কীভাবে বেড়েছে?

শুধু মোজাম্মেল নন। তার মত ১৫ জন হোল্ডিং মালিক সিটি কর্পোরেশনের প্রস্তাবিত পৌরকর নিয়ে ‘অনিয়ম’ এর অভিযোগ করেন গণশুনানিতে। বেশিরভাগই অভিযোগ করেন একলাফে কয়েক গুণ গৃহকর বেড়েছে। এদের কেউ কেউ কর্পোরেশনের কর আদায়কারীদের বিরুদ্ধে কর কমিয়ে দেয়ার নাম করে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ করেন। করদাতা সুরক্ষা পরিষদের নেতৃবৃন্দ বলেন, সময় স্বল্পতার জন্য সবার অভিযোগ শোনা সম্ভব হয়নি। না হলে অভিযোগের সংখ্যা বাড়ত।
ট্যাক্স কমাতে ‘ঘুষ’ দাবি : মোগলটুলীর বাসিন্দা আবু তাহের জাবেদ অভিযোগ করে বলেন, ৮৫৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট আছে আমাদের। সেখানে ৭৮ হাজার টাকা ট্যাক্স ধার্য্য করেন। মহসীন নামে কর্পোরেশনের এক ট্যাক্স অফিসার এসে আমাকে বলেছেন ট্যাক্স অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় মামলা হবে। পরে তিনি তাদের অফিসারের সঙ্গে বসে সুরাহা করার প্রস্তাব দেন। এরপর বয়স্ক একজন অফিসার নিয়ে আসেন তিনি। ওই অফিসার আবার প্রস্তাব দেন, চা-পানি খাওয়ার জন্য ১৩ থেকে ১৭ হাজার টাকা দিলে ৭৮ হাজার টাকার ট্যাক্স ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা করে দিবেন। আমি সে ‘ঘুষ’ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছি।

জাবেদ বলেন, আমরা মেয়র মহোদয়কে বলতে চাই, আপনি আগে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে সিটি কর্পোরেশনকে ঘুষখোর ও দুর্নীতিমুক্ত করুন। নাগরিকদের যে সব অধিকার আছে তা পূরণ করুন। নালা-নর্দমা পরিষ্কার করুন।

একই অভিযোগ করেন ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের হাসান মুরাদ শাহ। তিনি বলেন, নতুন নির্মিত ৭২০ বর্গফুটের ঘরের এসেসমেন্ট করতে সিটি কর্পোরেশনের একজন এসআর ও অফিসার আসেন। তাদের জিজ্ঞেস করলে আনুমানিক ৪০-৫০ হাজার টাকা ট্যাক্স আসার সম্ভাবনার কথা জানান। এটা নিয়ে প্রশ্ন করলে তারা দুই-চারদিন পর নক করবেন বলে জানান। পরে ট্যাক্স ১৫ হাজার টাকা করে দেয়ার কথা বলে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। এতে আমি আপত্তি জানাই। কারণ ট্যাক্স ও ঘুষ দুটো মিলিয়ে তো ৪৫ হাজার টাকা হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, আমার ওয়াসার পানির লাইন আনতে হবে। হোল্ডিং ট্যাক্স ছাড়া সেটা সম্ভব না। সে জন্য বাধ্য হয়ে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিই। পরে আমি সেটা মিডিয়ার সামনে তুলে ধরি এবং টাকা ফেরত চাই। কিন্তু এসেসর জানিয়েছে, ঘুষ হিসেবে নেয়া ১০ হাজার টাকা নাকি বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ হয় গেছে। পরে চাপে পড়ে সে ঘুষের টাকা ফেরত দিয়েছে।

আবদুল্লাহ আল আমিন নামে আরেক ভবন মালিকের দাবি, ৪ হাজার ৮০ টাকার গৃহকর বাড়িয়ে ৩৫ হাজার ৮৭০ টাকা ধার্য্য করা হয়। তিনি বলেন, ২০ হাজার টাকায় কন্ট্রাক্ট করলে ৫০ পার্সেন্ট কমিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। অন্যথায় পাঁচ হাজার টাকায় আপিল করতে বলেছে।

দেওয়ানপুকুর এলাকার শহীদপুত্র রাজীব আচার্য দাবি করেন, তপন দাশগুপ্ত নামে চসিকের একজন ঘুষ চেয়েছেন। ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুর রশীদের দাবি ১২ হাজার টাকা ট্যাক্স ৫ লাখ ১৩ হাজার টাকা ধার্য্য করা হয়েছে। আপিলে ৫০ শতাংশ কমালেও তো আড়াই লাখ টাকা হয়ে যাবে।

৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের আহমদ ছাপার দাবি, বিদ্যমান ট্যাক্স থেকে ৫০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আপিলের জন্য ২৮ জন ফ্ল্যাট হোল্ডার থেকে এক হাজার টাকা করে নিয়েছে। কয়েকদিন পর যা দিতাম তার চেয়ে চার গুণ বাড়িয়ে নোটিশ ধরিয়ে দেয়।

আহমেদ জসীমের দাবি, পাঁচ হাজার টাকার ট্যাক্স এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। ৭ নং সার্কেলের এসেসমেন্ট অফিসার মুজিবুর রহমান মৌখিকভাবে তা জানিয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, লিখিত দিতে বললেও দেয়নি।

১৫ হাজার টাকার কর এখন এক লাখ ৯২ হাজার টাকা : ৩৮ নম্বর নম্বর ওয়ার্ডের কামাল উদ্দিন বলেন, আমার হোল্ডিং (৮৬৫/১২২২) এর বিপরীতে ২০১১ সাল পর্যন্ত মূল্যায়ন ছিল ১১ হাজার ৪০০ টাকা। এর বিপরীতে ১৭ শতাংশ হারে কর দিয়েছি। পরে ২০১৫ সালে আপিলের মাধ্যমে বর্ধিত করে ১৫ হাজার টাকা হয়। বর্তমানে সেটা বেড়ে ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা করা হয়েছে। একইভাবে আরেকটি হোল্ডিংয়ে আট হাজার টাকাকে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা করা হয়। তিনি বলেন, এখন আপিলের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু টাকা না দিলে আপিল নিষ্পত্তি হয় না। আপিলে এক লাখ ৯২ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা কমানো হলেও তো কয়েক গুণ বেশি দিতে হবে।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর গৃহকর বাবদ ১১ হাজার ৪০০ টাকা পরিশোধ করেছি। সেটা ছিল ২০২২ সালের প্রথম থেকে ৪র্থ কোয়ার্টার পর্যন্ত। কিন্তু দুঃখের বিষয় ট্যাক্স কালেক্টর তাদের খাতায় লিপিবদ্ধ করেনি। করলে গত সেপ্টেম্বর মাসে নতুন কালেক্টর এসে বকেয়ার কথা বলতো না।

রামপুর ওয়ার্ডের খুরশিদ আলম বলেন, ৬০ হাজার টাকার ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা।

২৯ নং ওয়ার্ডের ৯৪৫/১০৬৫ হোল্ডিংয়ের মালিক আবুল হাসানের অভিযোগ, পূর্বে ৩১ হাজার ট্যাক্স দিলেও নতুন করে ধার্য্য করা হয়েছে এক লাখ ৯৭ হাজার ২০০ টাকা। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের এসেসর বলেছে নতুন ধার্য্যকৃত ট্যাক্স না দিলে বিপদে পড়ব। এখন দেখছি নোটিশটি নিয়ে গলাকাটা ট্যাক্স দেখে নিজেই বিপদে পড়েছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগৃহকরের ‘অনিয়ম ও দুর্নীতি’ দুদকে জানাবে সুরক্ষা পরিষদ
পরবর্তী নিবন্ধইউক্রেনে রুশ আক্রমণ দীর্ঘ সময়ের জন্য ভালো : বিল গেটস