ট্যাংকে ক্যালিব্রেশনে গোলমাল করে এক লাখ লিটার তেল গায়েব

যমুনা অয়েলের ফতুল্লা ডিপো । তদন্ত কমিটির রিপোর্টে মিলেছে সত্যতা ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে : কর্তৃপক্ষ

হাসান আকবর | বুধবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২৫ at ৭:৪৫ পূর্বাহ্ণ

যমুনা অয়েল কোম্পানির ফতুল্লা ডিপোর ট্যাংকে ক্যালিব্রেশনে গোলমাল করে তেল গায়েবের ঘটনার সত্যতা মিলেছে। এক লাখ লিটারের বেশি ডিজেল গায়েবের ঘটনায় গঠিত পাইপলাইন প্রকল্পের ২২ ও ২৩ নম্বর ট্যাংক রিক্যালিব্রেশনের লক্ষ্যে গঠিত ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উক্ত ট্যাংক দুটিতে ব্যাপক গরমিল ধরা পড়েছে। ৬ সদস্যের কমিটি তাদের বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর তেল গায়েবের ঘটনাটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

জানা যায়, চট্টগ্রামঢাকা পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ১৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামস্থ টার্মিনাল থেকে ফতুল্লা ডিপোতে প্রেরণের জন্য এক কোটি পাঁচ লাখ লিটার ডিজেল পাম্প করা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর ফতুল্লা ডিপোর ২২ ও ২৩ নম্বর ট্যাংকে তেল গ্রহণ করা হয়। ২২ নম্বর ট্যাংকের ধারণক্ষমতা ৬৯ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯ লিটার এবং ২৩ নম্বর ট্যাংকের ধারণক্ষমতা ৫০ লাখ ৪৭ হাজার ৯৭৭ লিটার। দুটি ট্যাংকে এক কোটি ৫ লাখ লিটার তেল পাঠানো হলেও পরবর্তীতে মোট ১ লাখ ১২ হাজার ৬১৪ লিটার বা ৯৪ দশমিক ৯৫ টন তেল কম পাওয়া যায়। বিপুল পরিমাণ তেল গায়েব করে দেয়া হয়েছে বলে জ্বালানি তেল সেক্টরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। অভিযোগ ওঠে, ফতুল্লা ডিপোকেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে কোটি কোটি টাকার তেল লোপাট করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ এক লাখ লিটারের বেশি ডিজেল গায়েব করে দেয়া হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর যমুনা অয়েল কোম্পানি ফতুল্লা ডিপোর ২২ ও ২৩ নম্বর ট্যাংক সিলগালা করে দেয়। কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে ক্যালিব্রেশনের কোনো সমস্যা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এজিএম (ইঅ্যান্ডডি) মোহাম্মদ আলমগীর আলমকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে এজিএম (ডিপো অপারেশন্স) শেখ জাহিদ আহমেদ, ম্যানেজার (অপারেশন্স) মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া, ম্যানেজার (ডিপো) আসলাম খান আবুল উলায়ী, পিটিসিএলপিএলসির ম্যানেজার (অপারেশন) ইঞ্জিনিয়ার রনি আহমেদ এবং সিডিপিএলের প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার রায়হান সরকার বিপুলকে সদস্য করা হয়। কমিটিকে ২২ ও ২৩ নম্বর ট্যাংকের পুনঃক্যালিব্রেশন কার্যক্রমের যথার্থতা, প্রক্রিয়া এবং পরিমাপের পার্থক্য বিষয়ে বিশদ তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশনা দেয়া হয়।

কমিটির সদস্যরা বিএসটিআইয়ের তালিকাভুক্ত ট্যাংক ক্যালিব্রেটর কোম্পানি চট্টগ্রামস্থ মেসার্স কর্ণফুলী ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপের প্রতিনিধিসহ ৩০ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর সরেজমিনে ফতুল্লা ডিপো পরিদর্শন করেন। ওই সময় ক্যালিব্রেটর কোম্পানি মেসার্স এস এম নুরুল হকের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

কমিটির সদস্যরা ট্যাংক নং ২২এর ২৪ এপ্রিল ২৪ সালের পুরাতন এবং ৫ মার্চ ২৫ সালের নতুন ক্যালিব্রেশন চার্ট এবং ট্যাংক নম্বর২৩ এর ৬ মে ২৫ সালের নতুন ক্যালিবেশন চার্টসহ সকল তথ্য সংগ্রহ করেন। এছাড়া বিএসটিআইয়ের তালিকাভুক্ত ট্যাংক ক্যালিব্রেটর কোম্পানি মেসার্স কর্ণফুলী ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপের নিয়োজিত প্রতিনিধি কর্তৃক গৃহীত ফিজিক্যালি মেজারমেন্টসমূহ পরীক্ষানিরীক্ষা করেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পর্যবেক্ষণকালে ট্যাংক নং ২২এর নতুন ও পুরাতন চার্টের মধ্যে পরিমাণগত তারতম্য পরিলক্ষিত হয়েছে। তাছাড়া ট্যাংক নং ২৩এর ক্যালিব্রেশন চার্ট সঠিক পাওয়া গেলেও বাস্তব মেজারমেন্টে সামান্য কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

ট্যাংক নং ২২এর ৫ মার্চ ২৫ সালের ক্যালিব্রেশন চার্ট অনুযায়ী ট্যাংকটির প্রতি মিমি তেল ধারণ ক্ষমতা গড়ে প্রায় ৫৯০ লিটার/মিমি হলেও ফ্র্যাকশন টেবিলে প্রতি মিলিমিটারে তেল ধারণ ক্ষমতা ৫৫২ লিটার/মিমি দেখানো হয়েছে। যেখানে প্রতি মিলিমিটারে পার্থক্য প্রায় ৩৮ লিটার। এছাড়া ফ্র্যাকশনাল চার্টও স্বাক্ষরিত অবস্থায় পাওয়া যায়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। নতুন ক্যালিব্রেশন চার্টে কোথাও ট্যাংকটির সেইফ হাইট উল্লেখ করা হয়নি। ক্যালিব্রেশন চার্টে ফিজিক্যাল ডাটা সংযোজন করা হয়নি। ক্যালিব্রেশন চার্ট অনুযায়ী ট্যাংকের ডায়ামিটার ২৭৪০৫.৬৬ মিমি এবং কমিটি কর্তৃক প্রাপ্ত ট্যাংকের ডায়ামিটার ২৭৪১৭ মিমি। ফলে ট্যাংকের ডায়ামিটার ১১.৩৪ মিমি কম পাওয়া গেছে।

২৩ নম্বর ট্যাংক নতুন তৈরি হয়েছে। তাই ২২ নম্বর ট্যাংকের পুরাতন ক্যালিব্রেশন চার্টের তুলনা করা সম্ভব হয়নি। ক্যালিব্রেশন চার্ট সঠিক পাওয়া গেলেও বাস্তব মেজারমেন্টে সামান্য কিছু পার্থক্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ক্যালিব্রেশন চার্ট অনুযায়ী ফ্র্যাকশনাল চার্ট স্বাক্ষরিত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। ক্যালিব্রেশন চার্টে কোথাও ট্যাংকটির সেইফ হাইট উল্লেখ করা হয়নি। ক্যালিব্রেশন চার্টে ফিজিক্যাল ডাটা সংযোজন করা হয়নি। ক্যালিব্রেশন চার্ট অনুযায়ী ট্যাংকের ডায়ামিটার ২১,৯২০ মিমি এবং কমিটি কর্তৃক প্রাপ্ত ট্যাংকের ডায়ামিটার ২১,৯২৮ মিমি। ট্যাংকের ডায়ামিটার ৮ মিমি কম পাওয়া গেছে।

কমিটির সদস্যরা নিজেদের পর্যবেক্ষণের উদ্ধৃতি দিয়ে রিপোর্টে উল্লেখ করেন, ট্যাংক নং ২২এর ৮ অক্টোবরের সংশোধিত ক্যালিব্রেশন চার্ট অনুযায়ী সেইফ হাইট হচ্ছে ১১৭৪০ মিলিমিলি এবং তেলের পরিমাণ ৭০,৩৮,৪০৪ লিটার। পুরতান ক্যালিব্রেশন চার্ট অনুযায়ী ১১৭৪০ মিমি উচ্চতায় তেলের পরিমাণ ৬৯,৭২,২১৭ লিটার। ফলে সংশোধিত চার্ট অনুযায়ী ট্যাংকের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির পরিমাণ ৬৬,১৮৭ লিটার।

ট্যাংক নং ২৩এর ৮ অক্টোবরের সংশোধিত ক্যালিব্রেশন চার্ট অনুযায়ী সেইফ হাইট হচ্ছে ১৩,২১০ মিমি এবং তেলের পরিমাণ ৫০,৫৯,২৮২ লিটার। পুরতান ক্যালিব্রেশন চার্ট অনুযায়ী ১৩,২১০ মিমি উচ্চতায় তেলের পরিমাণ ৫০,৪৭,৯৭৭ লিটার। ফলে সংশোধিত চার্ট অনুযায়ী ট্যাংকের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির পরিমাণ ১১,৩০৫ লিটার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, একটি সংঘবদ্ধ চক্র ট্যাংকের ক্যালিব্রেশনে গোঁজামিল দিয়ে বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকার তেল গায়েব করে দিয়েছে। ক্যালিব্রেশনের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে গোঁজামিলের ব্যাপারটি ধরা পড়ে।

যমুনা অয়েল কোম্পানির সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ক্যালিব্রেশনে গোলমালের ব্যাপারটি কোম্পানি সিরিয়াসলি নিয়েছে। এই ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ক্যালিব্রেশনে গোঁজামিল ভয়াবহ একটি ঘটনা। এই ধরনের গোঁজামিল দিয়ে যারা তেল চুরি করছেন তাদের শাস্তি নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যতে আরো বড় কেলেংকারি ঘটবে। দীর্ঘদিন ধরে যে ক্যালিব্রেশনের ওপর ভর করে তেল গ্রহণ এবং বিক্রি করা হচ্ছিল তাতে গোঁজামিলের ব্যাপারটি তদন্ত কমিটি দেখিয়ে দিয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
পরবর্তী নিবন্ধবাকলিয়া থানা পুলিশের ওপর ক্ষোভ মেয়রের