দীর্ঘদিনের অযত্ন ও অবহেলার পাশাপাশি অব্যবস্থাপনায় পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের টোল রোড ফ্লাইওভার। সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের টানাপোড়নে এটির বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দৈনিক প্রায় তিন হাজার ভারী গাড়ি চলাচলের ধকল সামলাতে গিয়ে বন্দরের নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল থেকে টোল রোডে সংযুক্ত হওয়া ফ্লাইওভারটির বিভিন্ন পয়েন্ট ফাটল এসেছে। বেয়ারিং নষ্ট হয়েছে। জয়েন্ট এক্সপ্রেনশার কাজ করছে না। ঝুঁকি সারাতে ফ্লাইওভারের গার্ডারে ‘ঠেস’ লাগানো হয়েছে। অবশেষে ফ্লাইওভারটির মেরামত শুরু হয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ ফ্লাইওভারটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিজেরা নিয়ে এটির মেরামত শুরু করেছে। এতে প্রায় তিন কোটি টাকা খরচের পাশাপাশি তিন মাস সময় লাগবে। তবে এটির উপর দিয়ে ভারী যান চলাচলে কোনো ঝুঁকি নেই বলে নিশ্চিত করেছে সড়ক বিভাগ। চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ির যাতায়াত সহজ এবং বিমানবন্দর সড়ককে যানজট মুক্ত রাখতে পোর্ট এঙেস রোড বা টোল রোডের সাথে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়। বন্দরের চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনাল (সিসিটি) এবং নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি) থেকে ফ্লাইওভারটি বিমানবন্দর সড়কের উপর দিয়ে টোল রোডে গিয়ে মিলিত হয়। ১৪২০ মিটার লম্বা ফ্লাইওভারটিতে মূল ফ্লাইওভার ৯৭৮ মিটার। বাকি অংশ দুদিকের র্যাম্প। চার লেইনের এই ফ্লাইওভারটি নির্মিত হওয়ায় বন্দরের পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় উন্নতি ঘটে। বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশের গাড়িগুলো শহরের রাস্তা ব্যবহার না করে এই ফ্লাইওভার হয়ে টোল রোড ধরে ফৌজদারহাটে গিয়ে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে চলে যায়। একইভাবে বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা ওই অঞ্চলের গাড়িগুলোও একই পথে বন্দরে প্রবেশ করে।
২০০৪ সালে নেয়া প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালের ১৫ মে। ৮২ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ৪৮ কোটি টাকা ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজে এবং বাকি টাকা ওয়াসা, বাখরাবাদ ও পিডিবির সরবরাহ লাইন সরানোসহ ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। সড়ক ও জনপথ বিভাগ ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করে বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করে।
হস্তান্তরের পর সড়ক ও জনপথ বিভাগ এটির রক্ষণাবেক্ষণ করেনি। বন্দরও করেনি। শুধু ব্যবহার হয়েছে। পরে ফ্লাইওভারের বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দেয়াসহ নানা সংকট তৈরি হলে এটির দায়দায়িত্ব নিয়ে টানপোড়েন শুরু হয়। বন্দর এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগকে দফায় দফায় পত্র দেয়। সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে বলা হয়, বিদেশি সহায়তায় ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করে বন্দরকে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন এটি রক্ষণাবেক্ষণ করার মতো টাকা তাদের কাছে নেই। এভাবে অযত্ন আর অবহেলায় ফ্লাইওভারটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।
চিঠি চালাচালির এক পর্যায়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ ফ্লাইওভারটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। কারণ বন্দরের কাছে এমন ফ্লাইওভার রক্ষণাবেক্ষণের মতো যন্ত্রপাতি বা সাপোর্ট নেই। ইতোমধ্যে ফ্লাইওভারের এঙপানশন জয়েন্ট ও প্লাস্টিকের কিছু বেয়ারিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো সময় মতো পাল্টানো হয়নি।
দায়িত্ব নেয়ার পর সড়ক ও জনপথ বিভাগ পুরো ফ্লাইওভারে সার্ভে করে ক্ষতিগ্রস্ত পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করেছে। এতে বিভিন্ন পিলার ও স্প্যানের অনেকগুলো এঙপানশন জয়েন্ট মেরামত করতে হবে। বেয়ারিং পাল্টাতে হবে। সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল কাজটি সম্পন্ন করতে তিন কোটিরও বেশি টাকা এবং তিন মাস সময় লাগবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ সম্প্রতি ফ্লাইওভারটির মেরামত কাজ শুরু করেছে। পিলারের সাথে রয়েল বোল্টের মাধ্যমে নাট বল্টু এবং শক–এবজরভার লাগিয়ে ঠেস দেয়া হয়েছে। গতকাল সরেজমিনে গেলে একাধিক গাড়ি চালক প্রশ্ন করেন, ৫০–৬০ টন পণ্য নিয়ে চলাচলকারী প্রাইম মুভারের চাপ এ ঠেস সামলাতে পারবে? ফ্লাইওভার নিয়ে অনেকের মধ্যে ভয় কাজ করছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু কুমার চাকমা বলেন, আমরা সংস্কার কাজ শুরু করেছি। তিন মাসের মতো সময় লাগবে। এঙপানশন জয়েন্ট ও বেয়ারিং পাল্টে দেব। ফ্লাইওভারে কোনো ঝুঁকি নেই। ঝুঁকি থাকলে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিতাম।
একজন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী বলেন, শুরু থেকে এই ফ্লাইওভার দিয়ে ধারণ ক্ষমতার বেশি ওজন নিয়ে গাড়ি চলেছে। এছাড়া বন্দরে ঢোকার সিরিয়াল দিয়ে শত শত ভারী গাড়ি ফ্লাইওভারে পার্ক করে রাখা হয়। অবৈধ পার্কিং ফ্লাইওভারটির ক্ষতি করেছে।