টোকাইয়ের আত্মসম্মান: এক নির্লজ্জ সমাজের বিবেকের আয়না

ছদরুল আলম চৌধুরী বাবলু | শুক্রবার , ১৩ জুন, ২০২৫ at ১০:২২ পূর্বাহ্ণ

আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে চারপাশে উন্নয়নের ঢাক পেটানো হয়, অথচ নৈতিকতা প্রতিদিন ধ্বংস হয় নীরবে। সমাজের শীর্ষস্থানে যারা আছেন, তারা বড় বড় কথা বলেনদেশ গড়ার, মানুষের পাশে দাঁড়াবার, স্বপ্ন দেখাবার। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের অনেক নেতা নিজের ঘরটাই গড়েন না, বরং গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়, আর রেখে যান অনৈতিকতার কালো দাগ।

আজকাল রাজনৈতিক নেতারা ঘুষ নেন, কমিশন ভাগ করেন, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে টাকার বান্ডিল গিলে ফেলেন, আবার চোখের সামনে গরিব মানুষ না খেয়ে মরলেও তাদের বিবেক জাগে না। রাষ্ট্রের দায়িত্বে থেকেও তারা ভুলে যান, যে টাকা তারা অপব্যবহার করছেন, সেটা কোনো বিদেশি অনুদান নয় এটা এক কৃষকের দিন মজুরের ঘামের দাম, এক দিনমজুরের না খেয়ে থাকা সন্তানের রুটির দাম। এমন সমাজেই দাঁড়িয়ে, একদিন, এক ‘টোকাই’ আমাদের শিখিয়ে দিল কীভাবে একজন মানুষকে বড় হতে হয়। একটি মুহূর্ত, একটি শিক্ষা।

রাজধানীর এক ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে ঘটে যায় এক সাধারণ অথচ অভাবনীয় ঘটনা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার গাড়ি থেমেছে, ভিড়, ফ্ল্যাশ, প্রটৌকলের শোরগোল। সেই সময় একটি ছোট পথ শিশু, যে পথেই বড় হয়েছে, যাকে আমরা ‘ভিক্ষুক’ কিংবা ‘আবর্জনা কুড়ানো ছেলে’ বলে অবহেলা করি, সে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। তাকে ডেকে দেওয়া হলো কিছু টাকা। কিন্তু এই শিশুটি সেই অর্থ নেয়নি। সে মাথা নাড়িয়ে বলল: ‘টাকা লাগবে না, দোয়া কইরেন।’

তারপর সাংবাদিকদের দিকে ফিরে সে বলে: ‘উনারা তো দেশ চালায়। আমি উনাদের কাছ থেকে টাকা নেব কেন? এই টাকা তো দুবেলা খেলেই শেষ হয়ে যাবে, মানুষ মন্দ বলবে।’ এই একটি বাক্য যেন চারপাশের সমস্ত মিথ্যাকে চুপ করিয়ে দেয়। যেখানে ক্ষমতার লোকেরা হিসাব ছাড়াই হাত বাড়ায়, সেখানে এক গরিব শিশু জানে আত্মসম্মান কত দামি।

আমাদের রাজনীতি: চেতনার বিপরীতে প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবস্থাপনা আমাদের রাজনীতিতে নেতৃত্ব মানেই এখন ক্ষমতা, পদের অপব্যবহার, আত্মপ্রচার আর জনসম্পদে হাত দেওয়ার লাইসেন্স। আমরা যখন শুনি হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, তখন একটি মুখও দেখি না, যেটি বলে:

এই টাকা আমার না। এটা দেশের, মানুষের।’ কোনো নেতা লজ্জা পায় না, কেঁদে ওঠে না, এমনকি মুখ নামিয়েও রাখে না। অথচ এক গরিব শিশু যার কাছে একশো টাকাই অনেক সে তা ফিরিয়ে দিয়ে শেখায়, ‘সম্মান সস্তা না, লোভী হলে মানুষ মন্দ বলবে।’

এই সমাজে যদি সেই শিশুটি নেতা হতো আমরা কী দেখতাম? একজন নেতা, যার নেই প্রাডো গাড়ি, নেই লাফালাফি করা ক্যাডার বাহিনী। কিন্তু যার আছে বিবেক, আত্মসম্মান, মানুষের চোখে সৎ থাকার সাধ। দুর্ভাগ্য হলো, এই সমাজে এমন মানুষ নেতা হতে পারে না। কারণ, এখানে নেতা হতে লাগে টাকা, পেশীশক্তি, ক্ষমতার সংযোগ, আর ভালো কিছু ভুলে থাকার অভ্যাস।

একদিন, হয়তো সেই টোকাই বড় হবে। হয়তো সে কখনো স্কুলে যাবে না, কখনো ভালো পোশাক পরবে না, কখনো মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনে কথা বলবে না। কিন্তু তার এই ছোট্ট সিদ্ধান্তই একদিন মানুষের মনে থাকবে: ‘টাকা লাগবে না, মানুষ মন্দ বলবে।’ এই বাক্যটি একটাই প্রমাণ করে একজন প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট নয়, লাগে সৎ ও ন্যায় পরায়ন হৃদয়।

দেশ বদলাবে সেদিন, যেদিন একজন নেতৃত্বের মুখ থেকে এই কথাটা বের হবে: ‘আমি এমন কিছু চাই না, যার জন্য মানুষ আমাকে মন্দ বলবে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৃষ্টি পড়ে
পরবর্তী নিবন্ধহযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর আত্মত্যাগ