উন্নয়নশীল জাতের উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, সার ও যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান, সহজ শর্তে কৃষিঋণ বিতরণ ইত্যাদির জন্য দেশের শস্য নিবিড়তা অনেক বেড়েছে। বিবিএসের তথ্যমতে, ২০০১-০২ থেকে ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত দেশের প্রধান খাদ্যশস্যগুলোর উৎপাদন প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। গত ৫০ বছরে দেশে চাল উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। স্বল্প জমিতে অধিক উৎপাদন করতে গিয়ে মাটির ওপর ক্রমাগত চাপ বেড়েছে। ফসলে অধিক ফলনের আশায় কৃষক প্রতিনিয়ত অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। ফলে জমি হারাচ্ছে তার উর্বরা শক্তি। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) পরিচালিত ‘ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ৫ শতাংশ হলে সে মাটিকে সবচেয়ে ভালো বলা হয়। কিন্তু এদেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ এখন গড়ে ২ শতাংশে নেমে এসেছে। এছাড়া দেশের মোট জমির প্রায় ৭৯ শতাংশে জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে। চাল প্রধান খাদ্য হওয়ায় বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ জমিতেই ধান আবাদ হচ্ছে। একই জমিতে দীর্ঘ সময় ধরে শুধু ধানই আবাদ হচ্ছে। মাটির উর্বরাশক্তি হ্রাসের জন্য অতিরিক্ত কীটনাশক, রাসায়নিক সারের ব্যবহার এবং একই ফসল টানা উৎপাদনকে দায়ী করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা অনেক ক্ষেত্রে পরিমাণ মতো সব সুপারিশকৃত সার প্রয়োগ করতে পারছেন না। সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ বাংলাদেশের একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যেটি মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাস করছে। জমিতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ফসলের ধরন পরিবর্তনের নানামুখী উপকারিতা রয়েছে। এটি জমির আগাছা দমনে সহায়ক, পোকামাকড়ের আক্রমণ কমায় ফসলের রোগবালাই কম হয়, সর্বোপরি ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায়। একইভাবে লিগিউম ফসল আবাদ করলে এটি বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন মাটিতে আবদ্ধ করে, মাটির জৈব উপাদানের পরিমাণ ও পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায় এবং মাটির অভ্যন্তরীণ পুষ্টি প্রবাহ বৃদ্ধি করে। ফলে মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়। কৃষিজমি ব্যবহার ও মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন না করলে চরম সংকটে পড়তে পারে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও পরিবেশ। কৃষকরা যাতে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী মাটি পরীক্ষা এবং সেই অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে পারেন এজন্য কিট ব্যবহার প্রসঙ্গে কৃষকদের সচেতনতাও বাড়াতে হবে। তাছাড়া ডিলারদেরও সারের সুপারিশ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে এবং তারা যেন ইচ্ছামতো সার বিক্রি করতে না পারেন। বর্তমানে নিরাপদ খাদ্যের জন্য বিশ্বব্যাপী উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা, ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার, প্রেসিশন এগ্রিকালচারের যে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যেখানেও নিরাপদ ও দক্ষ মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেসব দেশে জমির অভাব নেই, তারাও মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে অত্যন্ত যত্নশীল হচ্ছে। এসডিজির ১, ২, ৩, ৬, ১২, ১৪ ও ১৫ নং লক্ষ্য অর্জন লাগসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় ক্রপ জেনিং, ক্রপ প্লেনিং, সয়েল প্লেনিং করতে হবে। মাটির স্বাস্থ্যরক্ষায় মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। গবেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করছেন যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রক্রিয়ায় ২০৬০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান ফসলগুলোর ফলন ব্যাপক হারে হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে টেকসই মাটির উর্বরা শক্তি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা গেলেই কেবল বৈশ্বিক পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রক্রিয়া মোকাবেলা করে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মাটির উর্বরা শক্তি ধরে রাখার জন্য বেশকিছু সুপারিশমালা প্রদান করেছে। মাটিতে পুষ্টি উপাদান ধরে রাখার জন্য সক্ষম (লিগিউম ফসল) ফসলের আবাদ, অধিক পরিমাণে ফসলের অবশিষ্টাংশ জমিতে সংরক্ষণ, জৈব সারের প্রয়োগ বাড়ানো, সঠিক মাত্রায় এবং সঠিক সময়ে রাসায়নিক সার প্রয়োগ ইত্যাদি অন্যতম। মাটির টেকসই উর্বরা শক্তি ব্যবস্থাপনার জন্য এসব সুপারিশ অনুসরণ করে ফসল আবাদ করা একান্ত জরুরি। তবে এসব সুপারিশ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না।