জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে দশ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছে। প্রতিনিধি দলটি আজ বুধবার (২৬ মে) সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করে।
এর আগে সকাল ৯টার দিকে জাতিসংঘের একটি বিশেষ ফ্লাইট যোগে জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্ট ভলকান বজকির-এর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছে।
প্রতিনিধি দলের অন্যান্যরা হচ্ছেন ঢাকাস্থ তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান, অস্ট্রেলীয় দূতাবাসের মিস থেগান ইলিজাবেথ ব্রিন্ক, পাকিস্তানী দূতাবাসের ফারু খান, তুরস্কের ওনসো কেচেলি, কেরেন হান্ডে ওজোর, তঘরুল গুনাইদিন, ইন্দোনেশিয়ার আহমদ আলমাদুদী আমরী, আয়ারল্যান্ড দূতাবাসের উরলা মেরী ও ত্রিনিদাদ এন্ড ট্যোবাগো দূতাবাসের ফ্রান্সিস লিংক্লন কেরুন।
প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় সোয়া ১১টা পর্যন্ত ক্যাম্প-৪ এর দরবার হলে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
সভায় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান রেজওয়ান হায়াত (অতিরিক্ত সচিব) এবং অতিরিক্ত কমিশনার (উপ-সচিব) শামসুদ্দোহা ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাম্পের ইনচার্জ (সিআইসি), সহকারী ক্যাম্প ইনচার্জগণ, কক্সবাজার ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক নাইমুল হক, রামু সেনা নিবাসের লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান মাহমুদ পিএসসি ও বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
৩৪টি রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্পের অন্তত ৪০ জন রোহিঙ্গা প্রতিনিধি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক নাইমুল হক। তিনি বৈঠকে অংশগ্রহণ করা রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের বরাত দিয়ে জানান, রোহিঙ্গা প্রতিনিধিগণ মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সেই সাথে জাতিসংঘ সহ সকল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানান। ‘
হেড মাঝি মাহমুদুল্লাহ বলেন, “আমরা আমাদের নাগরিকত্ব, অধিকার এবং মর্যাদা সহ শান্তিপূর্ণভাবে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো আমরা সমঅধিকার এবং সম্মান মর্যাদা সহকারে যাতে মিয়ানমারে দ্রুত প্রত্যাবর্তিত হতে পারি সেজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কামনা করি।”
রোহিঙ্গা মহিলা প্রতিনিধি আফরোজা বলেন, “আমাদের বাংলাদেশে আগমনের চার বছর পূর্ণ হতে চলেছে। আমরা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে অবস্থান করছি। আমি আমার জীবনে তিনবার শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে এসেছি। ভবিষ্যতে আর আসতে চাই না। সেই জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিনীত অনুরোধ আমাদেরকে প্রত্যাবাসিত করা হলে তা যেন টেকসই এবং মজবুত হয়।”
হেড মাঝি মো. রফিক, মহিলা প্রতিনিধি রশিদা এবং হেডমাঝি মো. হোসেন বলেন, জাতিসংঘ যদি আমাদেরকে প্রত্যাবাসন করে সেই ক্ষেত্রে আমরা জাতিসংঘের কথামতো মিয়ানমারে যেতে রাজি আছি। ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জায়গায় আমাদের অবস্থান কিছুটা কষ্ট হলেও বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় আমরা এখানে ভালো আছি।
আমরা দ্রুত মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই, মিয়ানমারের ১৩৬ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ১৩৫ জাতিগোষ্ঠী নিবন্ধিত হলেও রোহিঙ্গারা আজও পর্যন্ত নির্যাতিত এবং অনিবন্ধিত রয়েছে।
আমরা অন্যান্য ১৩৫ জাতিগোষ্ঠীর মতো সমান অধিকার এবং মর্যাদা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সহকারে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
যদি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হয় তাহলে তাদের ছেলেমেয়েদেরকে শিক্ষার ব্যবস্থা করা জন্য অনুরোধও করেন তারা।
সবার বক্তব্য শোনার পর জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্ট ভলকান বজকির বলেন, “জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের সকল দুঃখ-দুর্দশার বিষয়ে অবগত আছে। রোহিঙ্গাদের পক্ষে তাদের সবসময় অবস্থান রয়েছে। জাতিসংঘ সর্বদা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টি করে আসছে। মিয়ানমারের সামরিক শাসন নিয়ে আমরা অবগত আছি। এ বিষয়ে দুশ্চিন্তার কিছুই নেই। সামনের মিটিংয়ে আমরা তাদেরকে নিয়ে বসব। আপনাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আলোচনা হবে।”
জাতিসংঘ সবসময় রোহিঙ্গাদের পাশে আছে এবং থাকবে। সেইসাথে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করবে এরূপ আশ্বাস প্রদান করেন তিনি।
পরে তিনি সকাল সোয়া ১১টার সময় ক্যাম্প-৪ এর সিআইসি অফিসের কনফারেন্স রুমে বিভিন্ন পদবীর কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করেন। এরপর পৌনে ১২টার দিকে সাংবাদিকদের সাথে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন শেষে জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্ট ভলকান বজকির উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প-৮ ডব্লিউ পরিদর্শন টাওয়ারে আরোহন করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দৃশ্য দেখেন এবং রোহিঙ্গা শিশুর সাথে সৌজন্যতাবোধ প্রদর্শন করেন।
এছাড়া,কুতুপালং ক্যাম্প-৯ এর জি ব্লকে আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ তুর্কি হাসপাতালের পুনঃনির্মাণ কাজ পরিদর্শন এবং তুর্কি হাসপাতালে ডাক্তারদের সাথে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসাসেবা বিষয়ে এবং কুশল বিনিময় শেষে দুপুর ১টার দিকে ক্যাম্প ত্যাগ করেন।
উল্লেখ্য, নতুন-পুরনো মিলিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে বসবাস করছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তিন বছরের বেশি সময় ধরে কয়েকবার চেষ্টা পরও মিয়ানমারের অনীহার কারণে তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।