টেকনাফে পান চাষে বিপর্যয়

অতিবৃষ্টি ও দমকা হাওয়া

শাহেদ মিজান, কক্সবাজার | শনিবার , ১৬ আগস্ট, ২০২৫ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজার জেলায় পান চাষের জন্য মহেশখালী প্রসিদ্ধ হলেও সময়ের পরিক্রমায় এখন জেলার বিভিন্ন এলাকায়ও উল্লেখ্যযোগ্য হারে পান চাষ হচ্ছে। মহেশখালীর পর বেশি পান চাষ হয় সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে। কিন্তু সম্প্রতি এই উপজেলায় পান চাষে বিপর্যয় নেমেছে।

কৃষি সম্প্রাসরণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, টেকনাফে একসময় ‘গাছপান’ চাষ হলেও এক দশক ধরে মিষ্টিপানও চাষ হয়ে আসছে। টেকনাফের উৎপাদিত পান স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও সরবরাহ হয়। কিন্তু চলতি মৌসুমে টেকনাফের পানচাষে বিপর্যয় নেমেছে। অতিবৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক বৈরি পরিস্থিতির কারণে মড়ক ও বাতাসে ভেঙে পড়ায় পানচাষে ধস নেমেছে। এতে চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে।

টেকনাফের মাথাভাঙা এলাকার পান চাষি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ করে পানের বরজ করেছিলাম, কিন্তু দমকা হাওয়া আর অতিবৃষ্টিতে সব হেলে পড়েছে, পানি জমে গাছ পচে গেছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, টেকনাফ উপজেলায় ৫৭০ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়। উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের মাথাভাঙা, হাজামপাড়া ও মারিশবুনিয়া এলাকায় রয়েছে প্রায় দুই হাজার পানের বরজ। অতিবৃষ্টি ও দমকা হাওয়ায় একের পর এক পানের বরজ হেলে পড়েছে, জমে থাকা পানিতে গাছ পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে চাষিদের মুখে চিন্তার চাপ ও হতাশা দেখা যাচ্ছে। তবে কেউ কেউ বিকল্প উপায়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।

স্থানীয় চাষি মোহাম্মদ ফারুক বলেন, বরজের চারপাশে দড়ি দিয়ে শক্ত বেষ্টনী তৈরি করলে প্রবল বাতাসের ধাক্কা সামলানো যায়। সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকলে অতিবৃষ্টির পানি জমে থাকে না, আর গোড়ায় পলিথিন বিছিয়ে দিলে সহজেই পানি সরিয়ে দেওয়া সম্ভব। তিনি আরও বলেন, এখন তো আবহাওয়া অনিয়মিত। কখনো অসময়ে বৃষ্টি, কখনো আবার জোয়ারের লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ে। তাই আবহাওয়ার খবর জেনে পরিকল্পনা করে চাষ করাই একমাত্র উপায়। আমি সেই পথই বেছে নিয়েছি, আর সেইভাবেই পান চাষ চালিয়ে যাচ্ছি।

নূর মোহাম্মদ নামের আরেক চাষি বলেন, এবার বরজ আগাম বসাতে পারিনি অতিবৃষ্টির কারণে। সময়মতো পানগাছ লাগাতে না পারায় ফলনও প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়েছে। আগাম চাষ করতে না পারাই দামও অনেক কম পাই। যে খরচ ও শ্রমে চাষ করেছি, তা বিক্রির আয়ে কোনোভাবেই পোষাচ্ছে না। খরচ মেটাতে গিয়ে ঋণের বোঝা বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী মৌসুমে চাষ চালিয়ে যাওয়া নিয়ে ভাবতে হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবহার, বরজের ড্রেনেজ উন্নয়ন, গোড়ায় পলিথিন দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ এবং দমকা হাওয়ায় বেষ্টনী তৈরির মতো উদ্যোগই জলবায়ু সহনশীল চাষে সহায়ক হতে পারে।

টেকনাফ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, তিন বছর আগে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে উপজেলার ৩০ জন চাষিকে বরাদ্দ প্রদান ও আবহাওয়া ভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পান চাষে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তবে বর্তমানে বরাদ্দ সংকটের কারণে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম কিছুটা কমে গেছে। তবুও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নিয়োজিত কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত পান চাষিদের দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।

কক্সবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. বিমল কুমার প্রমাণিক বলেন, এক বছরে বিভিন্ন দুর্যোগে কক্সবাজার জেলায় প্রায় ৫ হেক্টর পান বরজ নষ্ট হয়েছে। কিছু এলাকায় প্রবল বাতাস ও লবণাক্ত পানি প্রবেশের কারণে পান গাছের ক্ষতি এখনও চলছে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব। মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও জোয়ারের ধরন বদলে যাওয়ায় টেকসই পান চাষের জন্য কৃষকদের দ্রুত পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন পদ্ধতি ও পরিকল্পনা নিয়ে চাষাবাদ করতে হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ জেলায় পান চাষের জমির পরিমাণ ২৮৫৫ হেক্টর। তদ্মধ্যে সবচেয়ে বেশি মহেশখালী উপজেলায় ১৬০০ হেক্টর, টেকনাফ উপজেলায় ৫৭০ হেক্টর। এছাড়াও রামুতে ২০০ হেক্টর, চকরিয়ায় ৫০ হেক্টর, পেকুয়ায় ২০ হেক্টর, সদর উপজেলায় ৮৫ হেক্টর এবং উখিয়ায় ৩০ হেক্টর জমিতে পান চাষ হচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭২টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৫৬টি পুরোপুরি অরক্ষিত
পরবর্তী নিবন্ধচন্দনাইশে সিলিং ফ্যানে ঝুলছিল গৃহবধূর মরদেহ