সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের পাহাড়ি ইউনিয়ন বাহারছড়া, হ্নীলা, হোয়াইক্যংয়ের অর্ধলাখ মানুষ অপহরণ আতঙ্কে অনিশ্চিত জীবন পার করছেন। দুর্গম গহীন পাহাড়ে আস্তানা গড়া ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে তারা ক্লান্ত। ডাকাতদের অপহরণ থাবা বর্তমানে এতটা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মানুষের স্বাভাবিক জীবনগতি থমকে গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, টেকনাফের এসব পাহাড়ি এলাকায় অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ১০–১২টি ডাকাত গ্রুপের অন্তত দেড়শতাধিক ডাকাত সদস্য এসব অপহরণ বাণিজ্যে জড়িত। তাদের হাতে রয়েছে, আধুনিক স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র। অপহরণের পর মুক্তিপণ দিয়ে বা কোনোমতে উদ্ধার করাই শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বের মধ্য সীমাবদ্ধ। তাই ডাকাতদের হাতে অপহরণ–মুক্তিপণ আদায় নিয়ন্ত্রণ ছাড়িয়ে গেলেও স্থায়ী সমাধান মিলছে না। এতে আতঙ্ক এবং ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয়দের মধ্যে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, টেকনাফের বাহারছড়া, জাহাজপুরা, লেদা, মুছনি, হ্নীলা, রইক্ষং, জাদিমুড়া ও হোয়াইক্যং এলাকায় প্রায় প্রতিদিন ঘটছে অপহরণের ঘটনা। গত এক বছরে এসব এলাকা থেকে অন্তত ১৮৫ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ গত অল্প দিনের মধ্যে ২৭ ব্যক্তি অপহরণের শিকার হন। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার অপহৃত ১৮ বনকর্মীকে উদ্ধার করা হয়। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন আরও ৭ জন। এভাবে গত পাঁচবছরে প্রতিদিন অপহরণের ঘটনা ঘটে চলছে।
স্থানীয় সংবাদকর্মী হুমায়ুন রশিদ জানান, বেশিরভাগ ঘটনায় টার্গেট করে আর্থিকভাবে সচ্ছল বা প্রবাসে আত্মীয়–স্বজন রয়েছে এমন পরিবারের সদস্যদের অপহরণ করা হয়। পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়া পর্যটক ও রোঙ্গিারাও অপরহণের শিকার হয়। প্রথম দিকে অপহরণের শিকার পরিবারগুলো প্রশাসনের চেষ্টায় অপহৃত স্বজনদের উদ্ধারের চেষ্টা করত। এতে হতাহতের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আনাকে বেশি নিরাপদ মনে করা হচ্ছে। ইতোপূর্বে ১০–১২ জনকে হত্যা করেছে অপহরণকারীরা। সর্বশেষ ১৮ জন বনকর্মীও মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি পেয়েছেন বলে খবর রয়েছে।
আইন–শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয়দের তথ্য মতে, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় বাণিজ্যে যাদের নাম এসেছে তারা হলেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ লম্বরী এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ও তার বোনের জামাই ইসমাইল, মোরশেদ বাহিনীর মোরশেদ, মো. রিদুুয়ান, ফয়সাল, ইয়াছিন, গফুর, নুর নবী মাঝি, তোফায়েল আহমেদ, মাঠপাড়ার কামাল, মো. ফারুক, নতুন পল্লান পাড়ার আবদুল্লাহ, সাবরাং কচুবনিয়ার মো. আব্দুল্লাহ, মহেষখালিয়া পাড়ার ইয়াছিন, দক্ষিণ নেঙ্গুল বিলের গফুর, আজিমুল্লাহ, ফেরদৌস আক্তার, মো. ইউনুছ, মো. রফিক, সাইফুল্লাহ, উত্তর লম্বরীর মো. আইয়ুব, হ্নীলা পানখালীর আনোয়ার, বাহারছড়া ইউনিয়ন নোয়াখালী পাড়ার ছৈয়দুল হক প্রকাশ লেংগা, আব্দুল আলী, সাইফুল, আব্দুল আলী, ছৈয়দুল হক ও কেফায়েত উল্লাহ। মিয়ানমারের কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে স্থানীয় চক্রের লোকজন মিলে অপহরণ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথে পাচারকারীদেরও যোগাযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের এক সদস্য বলেন, অপহরণের ভয়ে এই এলাকার লোকজন সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হন না। গত পাঁচ মাসে আমার এলাকায় অর্ধশতাধিক অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন বেশির ভাগ। হত্যার ভয়ে অপহরণের শিকার লোকজন থানায় যেতে চান না। বাহারছড়ার ইউপি সদস্য হুমায়ুন কবির বলেন, যতক্ষণ স্থানীয় মানুষ, আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জনপ্রতিনিধিরা যৌথভাবে কাজ না করবেন ততদিন এই অপরাধ রোধ অসম্ভব।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অপহরণের অধিকাংশ ঘটনার রহস্যভেদ করতে পারছে না পুলিশ ও অন্যান্য আইন–শৃক্সখলাবাহিনী। তারা শুধু অপহরণের ঘটনা ঘটলে কিছুটা তৎপরতা দেখায়। ঘটনার পর তদন্তে বা অপরাধীদের গ্রেপ্তারে কোনো অগ্রগতি থাকে না।
এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, প্রযুক্তির সহায়তায় অপহৃতদের অবস্থান জানার চেষ্টা করে পুলিশ। আমরা গত জানুয়ারি থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩৮ জন অপহৃতকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। ২০টি মামলায় বেশ কয়েকজন অপরাধীকে আটক করা হয়েছে।
কক্সবাজার র্যাব–১৫–এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, দুুর্গম পাহাড়ে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি অভিযানে অনেককে গ্রেপ্তারও করেছে র্যাবের আভিযানিক দল। সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর দীর্ঘ অভিযানে বনে অপহৃত ১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অপহৃতদের উদ্ধারের অভিযান চলছে।