বিশেষ কর্মসূচির আওতায় চট্টগ্রামে বস্তির বাসিন্দাদের টিকাদান কর্মসূচি গতকাল (২১ নভেম্বর) শুরু হয়েছে। নগরীর ঝাউতলা ছিন্নমূল বস্তি এলাকায় দুপুর ২টার দিকে এ টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। আমবাগান এলাকায় রেললাইনের পাশে চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয়ে দুটি বুথ স্থাপন করে এ টিকা দেয়া হয়। প্রথম দিন এখানে ৫০০ জনকে টিকা প্রয়োগের টার্গেট নির্ধারণ করা থাকলেও ৬০০ বস্তিবাসীকে টিকা দেয়া হয়েছে বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। মাঝখানে একদিন (আজ ২২ নভেম্বর) বিরতি দিয়ে পরবর্তী ২৩-২৫ নভেম্বর পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে। বিশেষ এই কর্মসূচির আওতায় চার দিনে মোট ২ হাজার বস্তিবাসী জনগোষ্ঠীকে টিকা প্রয়োগ করা হবে বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে।
বিশেষ করে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা জন্ম নিবন্ধন সনদ না থাকাসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে টিকার জন্য অনলাইনে যাদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ নেই এবং যারা রেজিস্ট্রেশন করতে পারেননি এ ধরণের জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে বিশেষ এই কর্মসূচি স্বাস্থ্য বিভাগের।
গতকাল দুপুরে টিকাদান স্থল ঘুরে দেখা যায়, করোনার টিকা নিতে বেশ আগ্রহ ভরেই বুথের সামনে ভিড় করেছেন স্থানীয় নারী-পুরুষ। এদের কেউ গৃহকর্মী, কেউ পোশাক কারখানার কর্মী, কেউ গৃহিণী। রিকশা-ভ্যানচালকও আছেন।
সবাই বস্তির বাসিন্দা। গত ফেব্রুয়ারি থেকে টিকাদান চললেও বিভিন্ন কারণে তারা টিকা নেননি বা নিতে পারেন নি। আগ্রহ থাকলেও কেউ কেউ নিবন্ধনের ঝামেলার কারণে টিকা নিতে পারেননি। কারও কারও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় নিবন্ধনও করতে পারেননি। কেউ আবার টিকা গ্রহণ নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু এখন ঘরের পাশে টিকা দেয়ায় দ্বিধা-সংশয় কেটে গেছে। টিকা নিতে বুথের সামনে লাইনে দাঁড়ানো নারী-পুরুষের মাঝে আগ্রহ-উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না।
টিকা গ্রহণের পর উচ্ছ্বাস দেখা গেছে তাদের চোখে-মুখে।
আগ্রহ থাকলেও নিবন্ধন জটিলতায় এতদিন টিকা নিতে পারেননি গৃহকর্মী সুফিয়া খাতুন। তবে রোববার (গতকাল) ঘরের পাশে নিবন্ধন ছাড়াই টিকা নিতে পেরে তাকে বেশ খুশি-ই দেখাল। সুফিয়া বলেন, মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করি। মালিকেরা সবাই টিকা নিতে বলেন। কিন্তু আমি তো রেজিস্ট্রেশন করতে পারি না। কেমনে করে তাও জানি না। তাই এতদিন টিকা নিতে পারি নাই। এখন রেজিস্ট্রেশন ছাড়া টিকা নেয়ার সুযোগ পাইছি। কোনো ঝামেলা হয় নাই। টিকা নিতে পেরে আমি বেশ খুশি।
টিকা গ্রহণের পর কি হয় তা নিয়ে দ্বিধা থেকে এতদিন টিকা নেননি পোশাক কর্মী খালেদা আক্তার। কিন্তু রোববার শেষ পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন তিনি। টিকা গ্রহণের পর উচ্ছ্বসিত খালেদা বলেন, এতদিন একটু ভয়ে ছিলাম। কিন্তু সবাই নিচ্ছে দেখে আমিও নিয়ে নিলাম। এখানে কোনো ঝামেলা ছাড়া টিকা দিয়েছি। ভালো লাগছে। আর ভয় কাজ করছে না।
একটি কম্পিউটার দোকানে গিয়ে টিকার জন্য নিবন্ধন করলেও এসএমএস না পাওয়ায় এতদিন টিকা নিতে পারেননি রিকশা চালক আবুল হোসেন। তবে ঘরের পাশে টিকা দিচ্ছে জেনে তালিকায় নাম তুলে রোববার টিকা নিয়েছেন তিনি।
অবশেষে টিকা নিতে পেরে বেশ খুশি আবুল হোসেন। এভাবে খুব সহজে টিকা নিতে পেরে সরকারকেও ধন্যবাদ জানান তিনি। প্রসঙ্গত, কোনো ধরনের রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কেবল তালিকাভূক্তির মাধ্যমে বস্তির বাসিন্দাদের এই টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে। আর এই তালিকা করেছে স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ ও ছিন্নমূল সমিতি। তাদের তালিকার ভিত্তিতেই চার দিনে দুই হাজার বস্তিবাসীকে টিকা দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এই বিশেষ কর্মসূচি সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. আসিফ খান। প্রথম দিন (গতকাল) ৬০০ জনকে টিকা দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বস্তিবাসী ছাড়াও বিশেষ এই কর্মসূচির আওতায় তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া সমপ্রদায়) জনগোষ্ঠী এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের করোনার টিকার আওতায় আনা হচ্ছে। এর আওতায় ৫০০ জন তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া সমপ্রদায়) জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনা হচ্ছে আজ সোমবার।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই জনগোষ্ঠীকে টিকা প্রয়োগ করা হবে। তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর একটি সংগঠনের তালিকার ভিত্তিতে এ টিকা দেয়া হবে। এর বাইরে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ৫০০ শিক্ষার্থী এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় ৬৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীও টিকা পাচ্ছেন এই কর্মসূচির আওতায়। শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিজিএমইএ’র অধীনে ১৫ হাজার, ক্লিফটন গ্রুপের ১০ হাজার, মাইডাস গ্রুপের ১ হাজার, কেইপিজেড-এর ইয়াং ওয়ান গ্রুপের ১৮ হাজার, ফোর এইচ গ্রুপের ২০ হাজার এবং বিএসআরএম গ্রুপের ৮০০ শ্রমিক-কর্মচারীকে বিশেষ এই কর্মসূচিতে টিকা প্রয়োগ করা হবে।
এর মধ্যে চুয়েটের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মাইডাস গ্রুপ ও বিজিএমইএ’র অধীন শ্রমিক-কর্মচারীদের টিকা প্রয়োগ শুরু হবে আগামীকাল ২৩ নভেম্বর (মঙ্গলবার)। বাকি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের টিকাদান গতকাল (২১ নভেম্বর) থেকেই শুরু হয়েছে। বিশেষ এ ক্যাম্পেইনের আওতায় সবাইকে অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে বলেও জানান চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. আসিফ খান।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী- বস্তিবাসীদের টিকাদান কর্মসূচি সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আসিফ খান, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. নুরুল হায়দার ও জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া। তৃতীয় লিঙ্গের টিকা কর্মসূচিতে সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আসিফ খান, সিভিল সার্জন অফিসের এমও ডা. কাজী ফাহিমা আফরীন ও ডা. মোছাম্মৎ ফয়জুন্নেছা এবং জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া। আর শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের টিকাদান কর্মসূচি সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আসিফ খান, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. নুরুল হায়দার, এমও (সিএস) ডা. ওয়াজেদ চৌধুরী অভি এবং জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া।